(প্রথম পর্ব এর পর থেকে) ফিরে আসছি আমির খানের বিষয়ে, নব্বই দশকের শেষের দিকে তার দুইটি সিনেমা ‘মান’ (১৯৯৯) এবং ‘মেলা’ (২০০০) দর্শক এবং সমালোচক কারো কাছেই গ্রহনযোগ্যতা পায়নি। এই দুই সিনেমার ব্যার্থতা আমির খানকে নতুন শতকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করে। নতুন শতকে আমির খান আবির্ভুত হন প্রযোজক হিসেবে। ২০০১ সালে তার প্রযোজনায় মুক্তি পায় আমির খানের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা সিনেমা ‘লাগান’। আশুতুশ গোয়ারিকারের পরিচালনায় এই সিনেমা আমির খান প্রযোজনা এবং অভিনয় করেন তার কাছের বন্ধুদের বিরোধিতার মুখে।
সেই ‘দিল’ এবং ‘ঘায়েল’ এর মত আমির খানের এই সিনেমাও মুক্তি পায় সানি দেওলের ব্লকবাস্টার ‘গাদ্দার’ সিনেমার সাথে। আগের মতো এবারো দুইটি সিনেমাই ব্যবসায়িক সফলতা পেতে সক্ষম হয়। শুধু তাই নয় ‘মাদার ইন্ডিয়া’ এবং ‘সালাম বোম্বে’ এর পর তৃতীয় সিনেমা হিসেবে অস্কারে মনোনয়ন পায় আমির খানের ‘লাগান’। পরবর্তিতে ফারহান আকতারের পরিচালনায় ‘দিল চাহতা হ্যাঁ’ তে অভিনয়ের মাধ্যমে নিজেকে আরো একধাপ উপরে নিয়ে যান এই তারকা। ‘লাগান’ এবং ‘দিল চাহতা হ্যাঁ’ দুইটি সিনেমাই বলিউডের ল্যান্ডমার্ক সিনেমা হিসেবে গন্য হয়ে থাকে।
‘দিল চাহতা হ্যাঁ’ এর পর বেশ লম্বা বিরতি দিয়ে তিনি পর্দায় ফিরেন ২০০৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ইতিহাস ভিত্তিক সিনেমা ‘মঙ্গল পান্ডে’ দিয়ে কিন্তু সিনেমাটি বক্স অফিসে ব্যর্থ হয়। তবে ২০০৬ সালে আমির খান আবার স্বরূপে ফিরেন। এই বছর তার দুইটি সিনেমা মুক্তি পায়, যা দর্শক-সমালোচক সবার কাছে গ্রহনযোগ্যতা পায়। এর মধ্যে ‘রঙ দে বাসন্তি’ গত দশকের অন্যতম স্মরণীয় সিনেমা। ২০০৬ সালের তার মুক্তিপ্রাপ্ত অন্য সিনেমা ‘ফানা’ বছরের ব্যাবসা সফল সিনেমারগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো। সিনেমার ব্যাপারে নিজের মেধা আর মননের সুবিচার করতে আমির খান সিদ্ধান্ত নেন সিনেমা পরিচালনার। সিনেমা দিয়ে টাকা আয়ের পাশাপাশি সিনেমার মাধ্যমে সমাজে প্রতিবন্ধী শিশুদের ব্যাপারে ধারণা বদলাতে তিনি পরিচালনা করেন ‘তারে জামিন পার’ (২০০৭)। শুধু আমির খান নয়, বলিউডে এযাবৎ কালে নির্মিত অন্যতম ভালো সিনেমা হিসেবে ‘তার জামিন পার’ প্রথম সারিতে থাকবে।
‘লাগান’, ‘দিল চাহতা হ্যাঁ’, ‘রঙ দে বাসন্তি’ এবং ‘তারে জামিন পার’ এর পর আমির খান কিছুটা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন শাহরুখ খানের সাথে স্নায়ুযুদ্ধে। নব্বইয়ের দশকে আমির খানকে নিয়ে কয়েকবার বিভিন্ন এওয়ার্ড অনুষ্ঠানে কৌতুক করেছিলেন শাহরুখ খান। ২০০৮ সালে নিজের ব্লগে তার কুকুরের নাম ‘শাহরুখ’ লিখে নিভে যাওয়া আগুনে নতুন করে ঘী ঢালেন আমির খান।
তবে এই বছরই পর্দার বাইরের পাশাপাশি শাহরুখের সাথে পর্দার লড়াইয়ে অবতির্ণ হন মি. পারফেকশনিশট। ২০০৮ সালে শাহরুখ খানের ‘রাব নে বানা দি জোরি’ মুক্তির ইছু দিনের মাথায় মুক্তি পায় আমির খানের একশন সিনেমা ‘গজনী’। এই সিনেমা দিয়েই বলিউডের সিনেমার বক্স অফিসের হিসেব নিকেশ পাল্টে দেন আমির খান। ২০০৮ সালের ক্রিসমাসে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমা বক্স অফিস কালেকশনের নতুন মাইলফলক তৈরী করতে সক্ষম হয়। ভারতের প্রথম সিনেমা হিসেবে ১০০ কোটি রুপি আয় করে ‘গজনী’ শুরু করে বক্স অফিস আয়ের নতুন ধারা। আর আমির খান শুরু করেন নতুন যুগের।
এর ঠিক পরের বছর মুক্তি পায় ‘মুন্না ভাই’ খ্যাত পরিচালক রাজ কুমার হিরানির পরিচালনায় আমির খানের ‘থ্রি ইডিওটস’। ‘গজনী’ যেখানে ১০০ কোটির মাইলফলক স্পর্শ করা প্রথম সিনেমা ‘থ্রি ইডিওটস’ সেখানে ২০০ কোটি আয় করা প্রথম সিনেমা। শুধু তাই নয় বলা হয়ে থাকে বলিউডের ইতিহাসের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেমা ‘থ্রি ইডিওটস’। পরের দুই বছর স্বভাব সুলভ বিরতি, ফিরেন ২০১২ সালে ভৌতিক থ্রিলার ধর্মি সিনেমা ‘তালাশ’ নিয়ে। সিনেমাটি দর্শক-সমালোচক মহলে সাড়া জাগাতে ব্যার্থ হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে ‘তালাশ’ই ছিলো তার একমাত্র অনুচ্চারিত এবং কিছুটা ব্যার্থ। কিন্তু নিজের ক্ষমতার জানান দিতে সময় নেননি এই তারকা। ২০১৩ সালেই তিনি ফিরেন স্বরূপে। এই বছর মুক্তি পায় আমির খান অভিনীত যশ চোপড়া ফিল্মসের ‘ধুম ৩’। এই সিনেমা দিয়ে আবারো বক্স অফিসে ঝড় তোলেন আমির খান। ধুম সিরিজের আগের দুই সিনেমার মত প্রশংসা না পেলেও এই সিনেমাটি ভারতীয় বক্স অফিসে ২৫০ কোটির বেশী আয় করতে সক্ষম হয়।
পরের বছরই আবার নতুন ইতিহাস গড়েন আমির খান। ২০১৪ মুক্তি পায় ‘থ্রি ইডিওটস’ এর পর রাজু ইরানির সাথে তার দ্বিতীয় সিনেমা ‘পিকে’। ‘গাজনী’ এবং ‘থ্রি ইডিওটস’ এর মত ‘পিকে’ও নতুন মাইলফলক তৈরী করে। প্রথম সিনেমা হিসেবে ভারতীয় বক্স অফিসে ৩০০ কোটির আয়ের রেকর্ড গড়ে আমির কাহ্নের এই সিনেমা। আমির খান আরো একবার প্রমাণ করেন ভারতে ভালো সিনেমা নির্বাচলে তিনিই অদ্বিতীয়।
‘পিকে’ মুক্তির পর এক বছর পর্দায় অনুপস্থিত ছিলেন আমির খান। এই সময়ে তিনি নিজেকে তৈরী করেন তার পরের সিনেমার জন্য। ২০১৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দাঙ্গাল’ সিনেমার জন্য তিনি নিজেকে ভেঙ্গে গড়েছেন নতুন করে। ভারতের কুস্তীগির মহাবীর ফোকাটের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি ওজন বাড়িয়েছেন কয়েক কেজি আবার ওজন কমিয়েছেনও এই ছবির কারনে। কোন গ্ল্যামার ছাড়া, চার সন্তানের বাবার চরিত্রে অভিনয় করে আমির প্রমাণ করেন, চরিত্রের প্রয়োজনে তিনি যেকোন কিছুতে বদ্ধপরিকর। নিজের প্রযোজনায় এই ছবিটি ভারতীয় বক্স অফিসে ৩৭৫ কোটির উপর ব্যবসা করতে সক্ষম হয় এবং এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যবসা সফল সিনেমা ‘দাঙ্গাল’। যদিও তার সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘থাগ অফ হিন্দুস্থান’ বক্স অফিসে সফলতার পাশাপাশি সমালোচকদের প্রশংসা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। এই মুহূর্তে আমির খান হলিউডের ক্লাসিক সিনেমা ‘ফরেষ্ট গাম্প’ সিনেমার রিমেকের শুটিং নয় ব্যস্ত সমত পার করছেন।
এটা সত্য যে, নব্বইয়ের দশকে সালমান খান এবং শাহরুখ খানের তুলনায় বক্স অফিসের হিসেবে পিছিয়ে ছিলেন আমির খান। কিন্তু নতুন শতকের শেষের দিকে এসে, ব্যবসায়িক সফলতার হিসেবে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন আমির খান। শুধু তাই নয় নিজের ভিন্নমাত্রার মার্কেটিং দিয়ে বলিউডকে দেখিয়েছেন সিনেমা প্রমোশনের নতুন রাস্তা। বহুমাত্রিক অভিনয়েরও সবচেয়ে বড় উদাহরণ আমির খান। ‘রঙিলা’ থেকে শুরু করে ‘দাঙ্গাল’ – প্রত্যেকটা সিনেমাতে তিনি এসেছেন ভিন্ন রুপে, ভিন্ন চরিত্রে, ভিন্ন বিষয়বস্তু নিয়ে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সালমান খান একাধিক ব্লকবাস্টার সিনেমা উপহার দিলেও কোনটাই আমির খানের সিনেমার মান বা ব্যবসায়িক পরিধিকে অতিক্রম করতে পারেনি। অন্যদিকে শাহরুখ খান নতুন দশকে অনেকটাই কোণঠাসা। যেখানে সালমান খান এবং আমির খান তাদের সিনেমা দিয়ে নতুন নতুন মাইলফলক স্পর্শ করছেন সেখানে শাহরুখ খান অনেকটাই ব্যাস্ত নিজের অস্তিত্বের লড়াইয়ে। শুধু ব্যবসায়িক ব্যর্থতা নয়, নিম্ন মানের ছবির কারনে শাহরুখ খান সমালোচিত হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। সবশেষ ২০১৮ সালে তার মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জিরো’ সিনেমার ব্যর্থতার পর আর কোন সিনেমায় এখনও দেখা যায়নি। যদিও শোনা যাচ্ছে তিনি ইয়াশ রাজ ফিল্মসের সিদ্ধার্ত আনন্দের পরিচালনায় ‘পাঠান’ সিনেমায় অভিনয় করছেন। এখন দেখার অপেক্ষা এই সিনেমা শাহরুখ খানকে বক্স অফিসের ইঁদুর দৌড়ে ফেরাতে পারে কিনা!
বিগত কয়েকটি সিনেমার পরিসংখ্যান বিবেচনায় আনলে দেখা যাবে যে, লড়াইটা এখন মূলত দুই খানের – সালমান খান এবং আমির খান। আমির খানের এখন পর্যন্ত ২টি এবং সালমান খানের তিনটি সিনেমা ইতিমধ্যে ৩০০ কোটির উপরে ব্যবসা করেছে, যেখানে শাহরুখ খানের সবচেয়ে ব্যবসা সফল সিনেমা ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ ২২৫ কোটি ব্যবসা করেছে। সিনেমার মান এবং বক্স অফিস বিবেচনায় এই মুহুর্তে আমির খানের প্রতিদ্ধন্দী আমির খান নিজেই। আর তার নিকট প্রতিদ্ধন্ধী হিসেবে আস্তে পারে সালমান খানের নাম।
আমির খানের সফলতার গল্প অন্য যেকোন তারকার চেয়ে আলাদা। নিজের ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তার সমসাময়িক অন্যদের তুলনায় সংখ্যায় কম সিনেমা করে, সিনেমার মানের দিকে মনোযোগ আজ দর্শকদের কাছে আমির খানকে করেছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তারকা। যে সিনেমার সাথে আমির খানের সম্পৃক্ততা আছে সে সিনেমা দর্শকদের হতাশ করবে না – এটাই দর্শকদের সবচেয়ে বড় বিশ্বাস। সিনেমার বিষয়বস্তু, উপস্থাপন, নিজেকে ভেঙ্গে নতুন করে গড়াই দর্শকদের কাছে আমির খানের প্রতিশ্রুতি। নিজের ভক্ত এবং দর্শকদের প্রতি দায়বদ্ধতাই তার সবচেয়ে বড় উপহার। এটাই আমির খানের স্টারডাম, এটাই আমির খানের স্বকীয়তা। তিনি স্টার, তিনি ট্রেন্ডসেটার, তিনি ভিন্নতার প্রতিশব্দ… সর্বপরি তিনি অভিনেতা আমির খান!
প্রথম পর্ব পড়ুন: বলিউডের তিন খানের দুই দশকঃ অভিনেতা ও সুপারস্টার আমির খান (প্রথম পর্ব)