সিনেমার পর্দায় গল্পকে দর্শকদের জন্য উপভোগ্য করে তুলতে নায়কের পাশাপাশি খলনায়কের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলা সিনেমার সোনালি সময়ে দর্শকরা পর্দায় রাজীব, হুমায়ূন ফরিদি, এটিএম শামসুজ্জামান, আহমেদ শরীফ, মিজু আহমেদ এবং খলিলের মত শক্তিশালী অভিনেতাদের খলনায়ক রুপে দেখেছেন। রুবেল, মান্না, ইলিয়াস কাঞ্চন, ওমর সানি, জসিম, অমিত হাসানদের সাথে এই পর্দায় খারাপ মানুষদের লড়াই সিনেমাকে দর্শকদের কাছে করেছে উপভোগ্য। ঢালিউডের যত খলনায়ক ছিলেন তাদের সবার পর্দা উপস্থিতি সিনেমার নায়কদের চেয়ে কোন অংশেই কম ছিলো না।
ঢালিউডের সোনালি সময়ের পর শাকিব খানের মত খলনায়কের চরিত্রে এককভাবে অভিনয় করেন মিশা সওদাগর। কিন্তু তার পূর্বসূরিদের সেই ঐতিয্য ধরে না রেখে বরং ক্রমাগতভাবে নিষ্ট করেছেন মিশা। অশ্রীল সিনেমায় অভিনয়ের পাশাপাশি নিম্নমানের অভিনয় দিয়ে রুচিশীল দর্শকদের কাছে বাংলা সিনেমাকে করেছেন ঘৃণার বিষয়। একের পর এক সিনেমায় অভিনয় করেছেন কিন্তু সেসব সিনেমায় না ছিলো কোন বৈচিত্র, না ছিলো কোন অভিনয়ের আভিজাত্য। অসম্ভব রকমের বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি এবং রুচিহীন সংলাপ দিয়ে ধীরে ধীরে পর্দায় খলনায়কের সম্মানকে নিয়ে এসেছেন তলানিতে।
তবে বাংলা সিনেমায় খলনায়কদের ঐতিয্যকে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার সম্ভবনা দেখা গেছে সাম্পতিক সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমায়। ঢালিউডের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, খলনায়কদের অনেকেই নায়ক হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত খলনায়কের অভিনয় দিয়েও দর্শকদের মনে স্থায়ী জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। আবার অনেকেই খলনায়ক হিসেবে যাত্রা শুরুর পর পর্দায় নায়ক হিসেবেও জনপ্রিয়া অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই তালিকায় সবার আগে যার নাম আসে তিনি ঢাকাই সিনেমার কিংবদন্তী অভিনেতা জসিম।
খলনায়ক থেকে নায়ক হওয়ার এই তালিকায় আছেন ডিপজল। বাংলা সিনেমায় অশ্রীলতার যে আগ্রাসন নব্বইয়ের দশকের শেষে দেখা গিয়েছিলো তার অন্যতম ধারক এবং বাহক ছিলেন এই ডিপজল। ‘কদল আলী মাস্তান’, ‘কঠিন শাস্তি’, ‘তেরো পান্ডা এক গুন্ডা’ এরমত মত নিম্ন রুচির সিনেমাকে আরো বেশী নিম্নতায় নিমজ্জিত করেছিলো ডিপজলের অশ্রীল সংলাপ এবং অঙ্গভঙ্গি। ডিপজলের রুচিহীন নিম্ন মানের সিনেমা অনেক রুচিশীল দর্শকদের হল বিমুখ করেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে সেই ডিপজল একসময় নায়ক হয়ে পর্দায় হাজির হন। আর বর্তমানে বাংলা সিনেমা রক্ষার বড় বড় কথা দিয়ে গরম রাখেন মিডিয়া।
তবে বিগত কয়েক বছর ধরে আস্তে আস্তে হলেও বাংলা সিনেমার পালা বদলের কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত বেশ কয়েকটি সিনেমা কিছুটা হলেও দেশীয় সিনেমার প্রতি দর্শকদের আগ্রহ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এই সিনেমাগুলোর অন্যতম প্রধান ভালো দিক হচ্ছে মিশার পরিবর্তে খলনায়ক চরিত্রে নতুন মুখ। মানসম্মত গল্পের পাশাপাশি খলনায়কের মত গুরুত্বপূর্ন চরিত্রে এই অভিনেতাদের পর্দা উপস্থিতি দর্শকদের দিয়েছে নতুন স্বাদ। নতুন দিনের ঢালিউডের সম্ভাবনাময়ী কয়কেজন খলনায়ক নিয়ে আলোচনা করব আজকের এই লিখায়।
০১। তাসকিন রহমান
নতুন দিনের ঢালিউডের খলনায়কদের কথা বলতে গেলে সবার যে নামটি আলোচনায় আসে সেটি হচ্ছে তাসকিন রহমান। ২০১৭ সালে দীপঙ্কর দীপন পরিচালিত ‘ঢাকা অ্যাটাক’ সিনেমার মাধ্যমে সবার নজরে আসেন এই অভিনেতা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে সিনেমাটিতে নায়কের চেয়ে খলনায়ককে নিয়ে বেশী আলোচনা হয়েছে। শিশুশিল্পী হিসেবে বাংলাদেশ টেলিভিশনের কয়েকটি নাটকে অভিনয় করলেও তাসকিন সিনেমায় প্রথম করেন ১৯৯৫ সালে ‘হৃদয় আমার’ সিনেমায়। সিনেমাটিতে আমিন খানের ছোট বেলার চরিত্রে দেখা গেছে তাকে। লেখাপড়া শেষ করে অস্ট্রেলিয়া ফিরে তাসকিন অভিনয় করেন ‘আদি’, ‘মৃত্যুপুরী’, ‘অপারেশন অগ্নিপথ’ ও ‘ঢাকা অ্যাটাক’ সিনেমায়। কিন্তু এই অভিনেতার মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম সিনেমা হচ্ছে ‘ঢাকা অ্যাটাক’। বর্তমানে তাসকিল অভিনীত ‘অপারেশন সুন্দরবন’, ‘ক্যাসিনো’ ও ‘মিশন এক্সট্রিম’ সিরিজের দ্বিতীয় কিস্তিসহ বেশ কয়েকটি সিনেমা মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
০২। শিমুল খান
ঢাকাই সিনেমার অন্যতম উপেক্ষিত অভিনেতা শিমুল খান। ২০১৩ সালে ইফতেখার চৌধুরী পরিচালিত সুপারহিট ‘দেহরক্ষী’ সিনেমার মাধ্যমে ঢাকাই চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেন এই অভিনেতা। শুরু থেকেই খল নায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হন তিনি। নয় বছরে ৫০ টির বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন সম্ভাবনাময়ী এই অভিনেতা। আশিকুর রহমান পরিচালিত ‘মুসাফির’ সিনেমায় ছোট একটি চরিত্রে নিজের অভিনয়ের ঝলক দেখিয়েছিলেন শিমুল খান। কিন্তু এই অভিনেতাকে খুব বেশী সিনেমায় দেখা যায়নি। সিনেমার পাশাপাশি বাংলাদেশ এবং ভারতের কয়েকটি ওয়েব সিরিজেও দেখা গেছে শিমুল খানকে।
০৩। রাশেদ অপু
ঢাকাই সিনেমায় খলনায়ক হিসেবে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন ছোট পর্দার অভিনেতা রাশেদ অপু। অনন্য মামুন পরিচালিত শাকিব খানের ‘নবাব এলএলবি’ সিনেমায় খলনায়ক চরিত্রে দেখা গেছে অপুকে। সিনেমাটিতে নেতিবাচক চরিত্রে অপুর অভিনয় ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিলো। এরপর ‘জানোয়ার’, ‘দামাল’, ‘কসাই’ এবুং ‘অমানুষ’ সিনেমাতে খল চরিত্রে সবার নজর কাড়েন এই অভিনেতা। বর্তমানে তাঁর অভিনীত আরও আট থেকে দশটি সিনেমা মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। অভিনয়ের প্রথম দিকে আঞ্চলিক ভাষায় কমেডি চরিত্রে দর্শক হাসানো অপু এখন নেতিবাচক চরিত্রে নির্মাতাদের ভরসার নাম। পর্দায় তার অভিনয় প্রথাগত খারাপ মানুষদের অবয়ব ভেঙ্গে এনেছে নতুনত্ব। সামনের দিনগুলোতে অপু তার অভিনয় দিয়ে দেশীয় সিনেমার ভক্তদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বলে মনে করছেন সবাই।
০৪। শতাব্দী ওয়াদুদ
মঞ্চ নাটকের মাধ্যমে অভিনয় জীবনের যাত্রা শুরু করা শতাব্দী ওয়াদুদ বাংলাদেশী নাটক এবং সিনেমার পরিচিত নাম। বড় পর্দায় শতাব্দী ওয়াদুদকে নেতিবাচক চরিত্রে প্রথম দেখা গেছে ‘গেরিলা’ সিনেমায়। নাসির উদ্দীন ইউসুফের ‘গেরিলা’ সিনেমায় নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন শতাব্দী ওয়াদুদ। এরপর রাজ্জাকের ‘আয়না কাহিনী’ আর তানভীর মোকাম্মেলের ‘জীবনঢুলী’ সিনেমায়ও তাকে অনবদ্য অভিনয় করতে দেখা গেছে। এ ছাড়া রিয়াজুল রিজুর পরিচালনায় ‘বাপজানের বায়োস্কোপ’ এবং ‘চোখের দেখা’ নামের সিনেমায়ও খলনায়ক চরিত্রে দেখা গেছে তাকে। শতাব্দী ওয়াদুদকে ঢাকাই সিনেমার নির্মাতারা আরো ভালোভাবে ব্যবহার করলে দর্শক অভিনয়ের বৈচিত্রতা উপভোগ করার আরো সুযোগ পেতেন।
০৫। সুমন আনোয়ার
শাকিব খানের ‘নবাব এলএলবি’ সিনেমায় অপুর পাশাপাশি খলনায়ক চরিত্রে দেখা গেছে নির্মাতা সুমন আনোয়ারকেও। একজন চরিত্রহীন এবং দূর্নিতীবাজ রাজনীতিবিদের চরিত্রে তার অভিনয় দর্শকমনে জায়গা করে নিয়েছেন। তবে টিভি নাটক নির্মাণ করে পরিচিতি পাওয়া সুমনের শুরুটা হয়েছিলো মঞ্চ অভিনেতা হিসেবে। পরে কয়েকটি টিভি নাটকেও অভিনয় করতে দেখা গেছে তাকে। ‘নবাব এলএলবি’ সিনেমার পর ওয়েব ফিল্ম ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’ ও ‘সাত নাম্বার ফ্লোর’–এ নেতিবাচক চরিত্রে তাঁর অভিনয় দর্শকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত আলোচিত ‘হাওয়া’ সিনেমায়ও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। এছাড়া ওয়েব সিরিজ ‘কাইজার’-এও দেখা গেছে তাকে।
০৬। রোজী সিদ্দিকী
গত ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত আলোচিত ‘পরাণ’ ও ‘সাইকো’ সিনেমায় খল চরিত্রে অভিনয় করেছেন রোজী সিদ্দিকী। সিনেমাটিতে তার অভিনয় প্রশংসিত হয়েছে দর্শকদের কাছে। ঢাকাই সিনেমায় খল চরিত্রে পুরুষদের পাশাপাশি একটা সময় নারী শিল্পীদেরও আধিপত্য ছিল। রওশন জামিল, মায়া হাজারিকা, সুমিতা দেবী, রিনা খান কিংবা শবনম পারভীন একসময় সিনেমায় খল চরিত্রে নিয়মিত অভিনয় করেছেন। খল চরিত্রে নারী শিল্পীদের এই হারিয়ে যাওয়া ঐতিয্য ফিরিয়ে আনার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে রোজী সিদ্দিকীর অভিনয়ে।
০৭। এলআর খান সীমান্ত
‘নবাব এলএলবি’ সিনেমায় একটি ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছেন মডেল হিসেবে যাত্রা শুরু করা এলআর খান সীমান্ত। খলনায়ক হিসেবে তার পর্দা উপস্থিতি দর্শকদের নজর কাড়তে বেশী সময় নেয়নি। ‘নবাব এলএলবি’ সিনেমার পর অনন্য মামুন পরিচালিত ‘সাইকো’ সিনেমায়ও সীমান্তকে খল চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গেছে। নতুন দিনের ঢালিউডের সম্ভাবনাময়ী খলনায়ক সীমান্ত অভিনীত বর্তমানে বেশ কয়েকটি সিনেমা নির্মানাধীন রয়েছে। খল অভিনেতা হিসেবে সময়ের ব্যস্ততম এই অভিনেতার মুক্তির অপেক্ষায় থাকা সিনেমাগুলোর মধ্যে ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘ক্যাসিনো’, ‘লিডার: আমিই বাংলাদেশ’, ‘রিভেঞ্জ’, ‘মাসুদ রানা’ অন্যতম।
দেশীয় সিনেমায় নতুন সময়ের যে জোয়ার শুরু হয়েছে সে সময়ে খলনায়ক চরিত্রে নতুন এই অভিনেতাদের আগমন নিঃসন্দেহে ঢালিউডের জন্য ভালো খবর। এই অভিনেতারা নিজেদের প্রাথমিক গ্রহণযোগ্যতা ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছেন। এবার তাদের কাজে লাগিয়ে সিনেম্যাটিক বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাওয়ার বাকী কাজটা নির্মাতাদের। প্রিয় পাঠক উপরে উল্লেখিত নতুন দিনের ঢালিউডের খলনায়কদের ব্যাপারে আপনার মতামত আমাদের জানিয়ে দিতে পারেন মন্তব্যে।
আরো পড়ুনঃ
ঢালিউডের গৌরবময় অতীত: আমাদের সোনালি সময়ের সেইসব খলনায়কেরা