বিশ্বব্যাপী সিনেমায় সিক্যুয়েল এবং ফ্র্যাঞ্ছাইজি খুবই সাধারণ একটি বিষয়। হলিউড এবং বলিউড সহ মোটামুটি সব সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতেই নিয়মিতভাবে নির্মিত হয়ে থাকে সিক্যুয়েল এবং ফ্র্যাঞ্ছাইজি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সিনেমা পর্যালোচান করলে দেখা যায় যে, সিক্যুয়েল এবং ফ্র্যাঞ্ছাইজি নির্মাতাদের জন্য খুবই লাভবান হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। তবে সব ক্ষেত্রে এমনটা হয়ে থাকে সেটাও বলা যাবে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেমন সিক্যুয়েল আগের পর্বকে ছাড়িয়ে যায়, তেমনি অনেক সিনেমার সিক্যুয়েল আগের পর্বের সুনাম ক্ষুন্ন করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত সবচেয়ে আলোচিত সিক্যুয়েল হচ্ছে ‘কেজিএফ চ্যাপ্টার ২’। প্রথম সিনেমার মুক্তির চার বছর পর মুক্তি পেয়েছিলো যশ অভিনীত ‘কেজিএফ’ সিনেমার সিক্যুয়েল। এছাড়া গত বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত মোহনলাল অভিনীত ‘দৃশ্যাম ২’ সিনেমাটিও একটি আদর্শ সিক্যুয়েল সিনেমা ছিলো। অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওতে প্রদর্শনের পরই সিনেমাটি নিয়ে শুরু হয়েছিলো আলোচনা। জিতু জোসেফের অসাধারণ গল্প এবং চিত্রনাট্যের সাথে মেগাস্টার মোহনলালের অভিনয় সিনেমাটিকে দিয়েছে দুর্দান্ত জনপ্রিয়তা। আগের পর্বটি যেখানে শেষ হয়েছিলো, ঠিক সেখান থেকে শুরু হয়েছে সিনেমাটির দ্বিতীয় পর্ব।
প্রথম পর্বের গল্পের ধারাবাহিকতা ঠিক রেখে জিতু জোসেফ জর্জকুট্টির কাহিনী লিখেছেন নতুন রহস্যের মোড়কে। সিক্যুয়েল হিসেবে ‘দৃশ্যাম ২’ সবগুলো সম্ভাবনাকে ছাড়িয়ে গেছে। একই ভাবে, ‘কেজিএফ চ্যাপ্টার ২’ সিনেমাটিও সিক্যুয়েল হিসেবে বক্স অফিসে ঝড় তুলেছিলো। প্রথম পর্বে দেখানো রকি ভাইয়ের কেজিএফ দখলের পরের গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছিলো সিনেমাটি। যেমনটা দেখা গিয়েছিলো এস এস রাজামৌলী পরিচালিত ‘বাহুবলী’ সিনেমায়। আপনি না দেখে থাকলে অবশ্যই দেখা উচিত এরকম আরো পাঁচটি অসাধারণ সিক্যুয়েল নিয়ে আলোচনা করবো এই লিখায়।
১। এলিজাবেথ (১৯৯৮) এবং এলিজাবেথ: দ্য গোল্ডেন এজ (২০০৭)
শেখর কাপুর তার অস্কার মনোনীত ‘এলিজাবেথ’ সিনেমায় প্রথম এলিজাবেথের শুরুর বছরগুলির গল্প বলেছিলেন। সিনেমাটিতে তার ইংল্যান্ডের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়া এবং ক্ষমতায় তার প্রথম দিকের লড়াই দেখা গেছে। নয় বছর পরে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘এলিজাবেথ: দ্য গোল্ডেন এজ’ শিরোনামের সিক্যুয়েলটি প্রথম সিনেমার ঘটনাগুলি অনুসরণ করে এবং রানীর রাজত্বের পরবর্তী সময়ের কথা বলে। যদিও দ্বিতীয় পর্বটি অনেক নাটকীয়তায় ভরপুর এবং বেশ কাল্পনিক ছিল (এর জন্য সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছিলো), কেট ব্ল্যাঞ্চেটের অস্কার মনোনীত অভিনয় সিনেমাটিকে দিয়েছে অন্য রূপ। আর ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে পুরুষের অহংকারের সাথে লড়াই করে ক্ষমতায় একজন মহিলা হওয়ার অর্থ কী সিনেমাটি তার কিছুটা ধারণা আমাদের দেয়। রাজনীতি ও প্রেম উভয় ক্ষেত্রেই তাকে লড়াই করতে দেখা গেছে পুরুষ এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বিরুদ্ধে।
২। গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর – পার্ট ১ এবং ২ (২০১২)
বিস্তৃত এবং কয়েকটি জেনারেশন স্প্যানিং নিয়ে নির্মিত ‘গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর’ সিনেমাটি পূর্বনির্ধারিত ভাবেই দুই ভাগে মুক্তি পেয়েছিলো। দুই পর্ব মিলে সিনেমাটির গল্প মোট পাঁচ ঘণ্টার ছিলো। সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন রাম গোপাল ভার্মার একসময়ের সহকারী পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ। খুব দক্ষতার সাথেই সিনেমাটি নির্মান করেছিলেন এই নির্মাতার। সিনেমাটির একটি লাইনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছিলো পুরো সিনেমার প্রেক্ষাপট। ‘বাপ কা, দাদা কা, সব কা বদলা লেগা রে তেরা ফয়সাল’ – নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর মুখে এই সংলাপ দিয়েই দুই পর্বের গ্যাংস্টার ভিত্তিক এই প্রতিশোধের গল্পটি বলেছেন অনুরাগ কাশ্যপ। প্রথম পর্বের ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় পর্বটি শুরু হয় যেখানে ফয়সাল (নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী) তার গাঁজা-প্ররোচিত ঘুম থেকে জেগে উঠে জানতে পারে যে তার বাবা সর্দার খান (মনোজ বাজপেয়ী) খুন হয়েছেন। বিহারের প্রেক্ষাপটে সিনেমাটিকে অনুরাগ কাশ্যপের ‘দ্য গডফাদার’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।
৩। বিফোর সানরাইজ (১৯৯৫), বিফোর সানসেট (২০০৪) এবং বিফোর মিডনাইট (২০১৩)
রিচার্ড লিংকলেটারের বিফোর ট্রিলজিতে ইউরোপের প্রেক্ষাপটে শুধু রোমান্স নয় সেই সাথে উঠে এসেছে প্রেমের আবেগময় অনুভূতির গল্প। এই ট্রিলজির তিনটি পর্ব হচ্ছে ভিয়েনায় ‘বিফোর সানরাইজ’, প্যারিসে ‘বিফোর সানসেট’ এবং গ্রিসে বিফোর মিডনাইট। রোম্যান্টিক গল্পের এই সিনেমাটির প্রধান দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইথান হক এবং জুলি ডেলপি। এই ট্রিলজির প্রথম পর্বের গল্প আবর্তিত হয়েছে নতুন প্রেমের চমকপ্রদ সম্ভাবনাগুলিকে কেন্দ্র করে। দ্বিতীয় পর্বটিতে দেখা গেছে স্থান এবং সময়ের দূরত্ব প্রেমকে কিভাবে অনুপ্রাণিত করে এবং এই সময়ে আবেগের স্মৃতি টিকে থাকে কিনা। আর শেষ পর্বটিতে দেখানো হয় যে গোলাপের আভা এবং গোলাপের বুদবুদ থাকা সত্ত্বেও প্রেম কিভাবে একটি হৃদয়ে যন্ত্রণা হিসেবে টিকে থাকে। প্রতিটি পর্বেই আগের পর্বগুলোর গল্প এবং প্রেক্ষাপটের প্রতিফলন দেখা গেছে সেই সাথে যে সময় কেটে গেছে সে সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন করে তোলে।
৪। দ্য গডফাদার (১৯৭২) এবং দ্য গডফাদার পার্ট ২ (১৯৭৪)
সিক্যুয়েল নিয়ে আলোচনা আসলে ‘গডফাদার পার্ট ২’ সিনেমাটি থেকে ভালো কিছু পাওয়া যাবে কিনা তাতে সন্দেহ আছে। আগের পর্বের মত ‘দ্য গডফাদার পার্ট ২’ সিনেমাটি বিশ্ব চলচ্চিত্রের গ্যাংস্টার ধরনের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। ফ্রান্সিস ফোর্ড কোপলা পরিচালিত ও প্রযোজিত ১৯৭৪ সালের মার্কিন অপরাধধর্মী এই সিনেমাটি আংশিক মারিও পুজোর একই নামের বেস্ট-সেলিং উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। এছাড়া মারিও পুজো কোপলারের সাথে সিনেমাটির চিত্রনাট্যও রচনা করেছেন। সিনেমাটির প্রধান দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন আল পাচিনো ও রবার্ট ডি নিরো। সিনেমাটি ১৯৯৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের জাতীয় চলচ্চিত্র রেজিস্ট্রিতে সংরক্ষণের জন্য মনোনীত হয়, বলা হয় ছবিটি ‘সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং নান্দনিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ’।
৫। কিল বিল: ভলিউম ১ (২০০৩) এবং কিল বিল: ভলিউম ২ (২০০৪)
প্রতিশোধের গল্প নিয়ে নির্মিত হলিউডের অন্যতম আলোচিত নির্মাতা কুয়েন্টিন ট্যারান্টিনোর এই মহাকাব্যিক সিনেমাটি মোট দুই পর্বে মুক্তি পেয়েছিলো। একজন প্রাক্তন আততায়ী তার প্রাক্তন বস এবং সহযোগীদের হাতে নিজের বিয়ের আসরে নির্মমভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। সিনেমাটির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন উমা থারম্যান। চার বছর পরে জেগে ওঠার পর তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিশোধ নিতে একটি রক্তাক্ত পথ বেছে নেয়। তাকে যারা আঘাত করেছিল তাদের খুঁজে বের করতে শুরু করে এবং একে একে সবাইকে হত্যা করে। সিনেমাটির গল্পের জটিলতা বুঝতে হলে প্রথম পর্বের হিংস্র সেট, শক্তিশালী প্রতিপক্ষ এবং পিছনের গল্পগুলো জানা জরুরী। তবে অবশ্যই সিনেমাটির টুইস্ট আপনাকে চমকে দিবে। ছবিটিতে উমা থারম্যানের চরিত্র একাধারে একজন পেশাদার খুনী এবং স্নেহপরায়ণ মা যিনি সন্তানের মঙ্গলের জন্য যেকোনো বিপদের সম্মুখীন হতে পারেন।
০৬। টপ গানঃ ম্যাভেরিক
টম ক্রুজ অভিনীত সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘টপ গানঃ ম্যাভেরিক’ বক্স অফিসে ব্লকবাস্টার ব্যবসা করছে। চলতি বছরের ২৭শে মে মুক্তির পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রীতিমত ঝড় তুলেছে বহুল প্রতীক্ষিত এই সিনেমা। তিন দশকদের অপেক্ষার পর মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটি নিয়ে ভক্তদের আগ্রহও ছিলো আকাশচুম্বী। জোসেফ কোসিনস্কি পরিচালিত ‘টপ গানঃ ম্যাভেরিক’ সিনেমাটি পিটার ক্রেগ এবং জাস্টিন মার্কসের একটি গল্প থেকে অনুপ্রাণিত। সিনেমাটির চিত্রনাট্য রচনা করেছেন এহরেন ক্রুগার, এরিক ওয়ারেন সিঙ্গার এবং ক্রিস্টোফার ম্যাককুয়ারি। ‘টপ গান’ (১৯৮৬) এর সিক্যুয়েলটিতে টম ক্রুজ ক্যাপ্টেন পিট ‘ম্যাভারিক’ মিচেলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। এই লিখায় শুধুমাত্র সিক্যুয়েল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়ে নয়। সিক্যুয়েল এবং ফ্র্যাঞ্ছাইজির মধ্যে সুনির্দিষ্ট একটি পার্থক্য রয়েছে। সিক্যুয়েল সিনেমায় গল্পের ধারাবাহিকতা থাকে। অর্থাৎ একটি গল্পে যেখানে শেষ হয় পরের পর্বটি ঠিক সেখান থেকে শুরু হয় এবং গল্পকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। অন্যদিকে ফ্রাঞ্ছাইজি সিনেমায় মূল চরিত্রগুলোকে ঠিক রেখে একেকটি বিচ্ছিন্ন গল্প নিয়ে নির্মিত হয় একেকটি পর্ব।
আজকের পর্বে শুধুমাত্র সিক্যুয়েল সিনেমা নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। এখানে যে সিনেমার তালিকা রয়েছে তার বাইরেও বেশ কিছু সিনেমা রয়েছে যেগুলো আলোচিত এবং ব্যবসা সফল ছিলো। সিক্যুয়েল হিসেবে বর্তমানে বেশ কিছু সিনেমা মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত সিক্যুয়েল হচ্ছে ‘পুষ্পা পার্ট ২ – দ্য রাইজ’। আল্লু অর্জুন অভিনীত এই সিনেমাটির প্রথম পর্ব প্যান ইন্ডিয়া বক্স অফিসে ঝড় তুলেছিলো। গত ডিসেম্বরে মুক্তির পর থেকেই সিনেমাটির দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছেন ভক্তরা। আগের পর্বটি যেখানে শেষ হয়েছিলো ঠিক সেখান থেকেই শুরু হবে দ্বিতীয় পর্বের গল্প। দ্বিতীয় পর্বে দেখা যাবে আল্লু অর্জুন এবং ফাহাদ ফাসিলের লড়াই।
আরো পড়ুনঃ
অবিস্মরণীয় যে চরিত্রগুলো অভিনেতা কামাল হাসানের বহুমুখিতা প্রমাণ করে
শাহরুখ খানের যে ছয়টি সিনেমা জীবন সম্পর্কে আমাদের আশাবাদী করে!
নব্বইয়ের দশকে অ্যাকশন তারকা সানি দেওয়লের সেরা ৫টি অভিনয়ের সিনেমা