ভারতের সিনেমার ১০০ বছরের বেশি সময়ের ইতিহাসে প্রায় সাতজন প্রকৃত সুপারস্টার বা মেগাস্টার দেখা গেছে। এখানে প্রকৃত বা সত্যিকারের সুপারস্টার বলার একটি বিশেষ কারণ রয়েছে। আজকাল অনেক আঞ্চলিক সিনেমার তারকাদের সুপারস্টার বলার পাশাপাশি সংবাদ মাধ্যমগুলো সবার নামের পাশেই ‘সুপারস্টার’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। তাই সুপারস্টার শব্দটি তার মূল্য হারিয়ে ফেলেছে। ভারতীয় সিনেমা সম্পর্কে ইতিহাসবিদরা যদি সঠিক তথ্য-উপাত্ত নির্ভর কোন গবেষণা করেন, তাহলে সুপারস্টারের তালিকায় শীর্ষে থাকবেন দিলীপ কুমার, অমিতাভ বচ্চন এবং শাহরুখ খানের নাম।
সিনেমায় সুপারস্টার বা তারকা খ্যাতি খুব অঞ্চল ভিত্তিক কারণ একটি অঞ্চলে একজন তারকা সর্বকালের বৃহত্তম হতে পারে এবং তারপরে তিনিই অন্য অঞ্চলে সর্বকালের ৫ নম্বর হতে পারে। আঞ্চলিক সিনেমায় তারকাখ্যাতি এবং জাতীয় পর্যায়ের সুপারস্টার নিয়ে বিশাল প্রবন্ধ লেখা যেতে পারে। শুধু অঞ্চল হিসেবেই নয়, সময়ের হিসেবেও একেক সময় একেক জন তারকা দ্যুতি ছড়িয়েছেন। কিন্তু দিলীপ কুমার, অমিতাভ বচ্চন এবং শাহরুখ খানের কর্মজীবনে একটি বিশাল কিছু মিল রয়েছে। শুধু বলিউড নয়, ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসের সর্বকালের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার হিসেবে ঘুরে ফিরে এই তিনজনের নামই আসবে।
ভারতীয় সিনেমায় দিলীপ কুমার, অমিতাভ বচ্চন এবং শাহরুখ খানের কর্মজীবনের মিলের পাশাপাশি এই তিন তারকার উত্তান পতনের গল্পেও বিশাল সাদৃশ্য রয়েছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারকাদের জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা এবং বক্স অফিস সাফল্যের মাপকাঠি হয়ে উঠেছে তাদের সাফল্য এবং অর্জন। এরমধ্যে শাহরুখ খানের নামটা একটু বেশী উজ্জ্বল। ভারতীয় সিনেমায় একটি ধারণার প্রচলন রয়েছে যে, ‘ভারতে তারকাখ্যাতির মাপকাঠি ঠিক করে দিয়েছেন শাহরুখ খান।‘ এরপর কারো তারকাখ্যাতির উচ্চতা মাপার মানেই হচ্ছে শাহরুখ খানের তারকাখ্যাতির সাথে তুলনা।
এবার মূল আলোচনায় ফেরা যাক। দিলীপ কুমার, অমিতাভ বচ্চন এবং শাহরুখ খানের ক্যারিয়ারের যে সাদৃশ্য আমরা খোঁজে পাই তার মধ্যে অন্যতম একটি বিষয় হচ্ছে – খারাপ সময়কে পিছনে ফেলে ফিরে আসা। এই তিন তারকার প্রত্যেকেরই ক্যারিয়ার উত্তান এবং পতনের গল্পে মোড়ানো। তবে তিনজনের কেউই হাল ছাড়েননি। সবাই সাময়িক বিরতির পর সিনেমায় ফিরেছেন এবং নিজেদের নিয়ে গেছেন সাফল্যের চূড়ায়। তবে ফেরার এই গল্পে দিলীপ কুমার এবং অমিতাভ বচ্চনকে পিছনে ফেলে দিয়েছেন বলিউড বাদশা শাহরুখ খান।
ভারতীয় সিনেমার কিংবদন্তী অভিনেতা দিলীপ কুমার ১৯৭৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘বৈরাগ’ সিনেমার পর বিরতি নেন। তখন তার বয়স ছিলো ৫৩ বছর। সিনেমাটিকে ইন্ডাস্ট্রিতে একটি ফ্লপ হিসাবে দেখা হয় তবে বক্স অফিসের সংগ্রহে এটি একটি হিট বা এমনকি সুপারহিট ছিল। তবে ‘বৈরাগ’ সিনেমার আগে দিলীপ কুমার ছয়টি সিনেমা বক্স অফিসে ব্যর্থ হয়েছিলো। এছাড়া ‘বৈরাগ’ অনেক বিলম্বে মুক্তি পেয়েছিলো, তাই বিরতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত সম্ভবত ‘বৈরাগ’ মুক্তির অনেক আগেই নিয়েছিলেন এই অভিনেতা। যাইহোক, ‘বৈরাগ’-ই সাময়িক বিরতির আগে দিলীপ কুমার অভিনীত সর্বশেষ সিনেমা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
‘বৈরাগ’ মুক্তি পায় ১৯৭৬ সালের অক্টোবরে এরপর দিলীপ কুমার ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘ক্রান্তি’ সিনেমার মাধ্যমে বড় পর্দায় ফিরেন। মধ্যে ৫২ মাসের বিরতি ছিলো এই তারকার। ‘ক্রান্তি’ বক্স অফিসের প্রাথমিক সব রেকর্ড ভেঙ্গে দেয় কিন্তু দিলীপ কুমার এর প্রধান চরিত্রে ছিলেন না। সিনেমাটিতে তার চরিত্র ছিলো ‘চরিত্র শিল্পী’ হিসাবে। তবে এর মাধ্যমে তিনি একটি নজির স্থাপন করেছিলেন যে তার চলচ্চিত্রগুলি প্রধান চরিত্রের পরিবর্তে এই পুরোনো চরিত্রকে ঘিরে তৈরি হয় এবং বিশাল ব্লকবাস্টার হয়ে ওঠে। এটিই তাকে অন্যসব অভিনেতাদের থেকে আলাদা করে এবং মূলত এই কারণেই তিনি ভারতের সবচেয়ে বড় অভিনেতা।
৪৯ বছর বয়সে দিলীপ কুমারের পথে হাঁটেন আরেক কিংবদন্তী অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন। ‘খুদা গাওয়াহ’ মুক্তি পাওয়ার পর তিনিও সিনেমা থেকে সাময়িক বিরতি নেন। বিশাল বাজেটে নির্মিত হওয়ার কারণে প্রত্যাশা অনুযায়ী ব্যবসা করতে পারেনি সিনেমাটি। সে সময়ে ‘আজ কা অর্জুন’ ছাড়া অমিতাভ বচ্চনের সিনেমাগুলো কয়েক বছর ধরে বক্স অফিসে ভালো আয় করতে সক্ষম হচ্ছিলো না। ‘খুদা গাওয়াহ’ সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিলো ১৯৯২ সালের মে মাসে। এরপর অমিতাভ বচ্ছন দীর্ঘ ৬০ মাস বড় পর্দায় অনুপস্থিত ছিলেন। মধ্যে ‘ইনসানিয়াত’ সিনেমায় তাকে অতিথি চরিত্রে দেখা গেলেও সেটি আসলে এর বিলম্বিত মুক্তির কারনে।
৬০ মাসের বিরতির পর অমিতাভ প্রধান চরিত্রে বড় পর্দায় ফিরেন ১৯৯৭ সালে। ১৯৯৭ সালের মে মাসে মুক্তি পেয়েছিলো অমিতাভ বচ্চন অভিনীত ‘মৃত্যুদাতা’ সিনেমাটি। প্রধান চরিত্রে অমিতাভ বচ্চনের ‘মৃত্যুদাতা’ বক্স অফিসে ব্যার্থ হয়েছিলো। এছাড়া প্রধান ভূমিকায় সে সময় তার অন্য সিনেমাগুলোও সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। অবশেষে অমিতাভ বচ্চনকে প্রধান চরিত্র থেকে স্থানান্তরিত হতে হয়েছিল। তবে এখন পর্যন্ত ‘চরিত্র শিল্পী’ হিসাবে অমিতাভের ক্যারিয়ার যেকোন অভিনেতার জন্য কল্পনার অতীত। কিন্তু এটাও সত্য যে, দিলীপ কুমার যে ধরণের চলচ্চিত্র এবং ভূমিকা পেয়েছিলেন তা অমিতাভ বচ্চনের জন্য সহজলভ্য ছিলো না।
এদিকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে শাহরুখ খান অভিনীত ‘জিরো’ সিনেমাটি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পরেছিলো। শুধু তাই নয়, ‘জিরো’ সিনেমার আগের সিনেমাগুলোও বক্স অফিসে ব্যার্থ হয়েছিলো। সেই কারনে ‘জিরো’ মুক্তির পর ৫৩ বছর বয়সে অভিনয় থেকে সাময়িক বিরতি নেন শাহরুখ খান। আর ৪৯ মাসের বিরতির পর ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ‘পাঠান’ সিনেমার মাধ্যমে বড় পর্দায় প্রত্যাবর্তন করেন বলিউড বাদশা। স্পাই অ্যাকশন থ্রিলার গল্পের সিনেমাটি বিশ্বব্যাপী বক্স অফিসে রীতিমত সুনামি বইয়ে দিয়েছে। একমাসের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী সিনেমাটির আয় ১০০০ কোটি রুপি ছাড়িয়ে গেছে।
আর এই জায়গাতেই দিলীপ কুমার এবং অমিতাভ বচ্চনকে পিছনে ফেলে দিয়েছেন শাহরুখ খান। দিলীপ কুমার এবং অমিতাভ বচ্চন যেখানে প্রত্যাবর্তন করেছেন ‘চরিত্র শিল্পী’ হিসেবে সেখানে শাহরুখ খান ফিরেছেন প্রধান চরিত্রে (নাম ভূমিকায়)। তার প্রত্যাবর্তনের সিনেমাটির আয় ছাড়িয়ে গেছে বলিউডের ইতিহাসের সব সিনেমার আয়কে। বক্স অফিসে প্রাথমিক সব রেকর্ডের পাশাপাশি হিন্দি সিনেমা হিসেবে খুব শীগ্রই ‘পাঠান’ ভারতীয় বক্স অফিসে ছাড়িয়ে যাবে ‘বাহুবলীঃ দ্য কনক্লুশন’ সিনেমার আয়কে। বড় পর্দায় তার প্রত্যাবর্তনের গল্পটি একটি অনন্য ঘটনা কারণ বাকী দুই কিংবদন্তী যা করতে পারেননি, শাহরুখ খানের জন্য এটিই এখন সবচেয়ে বড় বাস্তবতা।
শাহরুখ খানের ‘পাঠান’ সিনেমাটির সাফল্য বলিউডে আরো একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। রোম্যান্টিক ইমেজ ভেঙ্গে অ্যাকশন তারকা হিসেবে ফেরার পাশাপাশি আরো একটি ক্ষেত্রে নতুন শাহরুখ খানকে দেখা গেছে। শাহরুখ খান ‘কিং অফ প্রোমোশন’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং এখনো তার পদ্ধতি অনুসরণ করে বাকীরা তাদের সিনেমার প্রচারণা করে থাকেন। কিন্তু ‘পাঠান’ সিনেমার ক্ষেত্রে সেই চিরচেনা শাহরুখ খানকে দেখা যায়নি। অযাচিত প্রচারণা এবং সস্তা আলাপচারিতা উপেক্ষা করে শাহরুখ খান তার প্রতি দর্শকদের আগ্রহ বাড়িয়েছেন কয়েকগুণ। একজন সত্যিকারের সুপারস্টার বা তারকার জন্য এটি একটি অপরিহার্য কৌশল।
নিয়মিত সংবাদ মাধ্যমের সাথে কথা বলা, টিভিতে উপস্থিতি, কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছোট ছোট ভিডিও প্রকাশ করে নিজেকে সহজলভ্য করেননি শাহরুখ খান। তিনি হয়তো, দর্শকদের এই বার্তাই দিয়েছেন যে, আমাকে দেখতে হলে প্রেক্ষাগৃহে আসতে হবে। ‘পাঠান’ সিনেমার ক্ষেত্রে এটিই তার তারকাখ্যাতির সবচেয়ে বড় প্রতিদান। মুক্তির পর থেকেই সিনেমাটি দেখতে প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। দীর্ঘ ৪৯ সপ্তাহ পর বড় পর্দায় ফিরেই শাহরুখ খান সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছেন সুপারস্টার শব্দের প্রকৃত অর্থ। দেখিয়ে দিয়েছেন কেন তিনি বলিউড বাদশা, কেন তিনি বলেছিলেন ‘তারকাদের আমিই শেষ তারকা’।
লিখাটি শেষ করতে চাই শাহরুখ খানের আরো একটি উক্তি দিয়ে। একটি আলাপচারিতায় এক প্রশ্নের উত্তের শাহরুখ খান বলেছিলেন, ‘আপনি আমাকে ঘৃণা করতে পারেন, আমাকে ভালবাসতে পারেন কিন্তু আমাকে অস্বীকার করতে পারবেন না।‘ হ্যাঁ, ‘পাঠান’ বক্স অফিস আরো একবার সেটি প্রমাণ করলো। মহামারী পরবর্তি বলিউড বক্স অফিসের অচলাবস্তাকে পিছনে ফেলে শাহরুখ খান উপহার দিলেন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক সফল সিনেমা। সেই সাথে সবাইকে শেখালেন, প্রচারণা মানেই নিজেকে সস্তা বানানো নয়।
দ্রষ্টব্যঃ বক্স অফিস ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের অনুকরণে।
আরো পড়ুনঃ
বয়কট এবং বলিউড: শাহরুখ খানের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ‘পাঠান’ (দ্বিতীয় পর্ব)
নির্বুদ্ধিতা আর আযৌক্তিকতায় অনন্য উদাহরণের ছয়টি বলিউড সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র
অ্যাকশন থেকে কমেডিঃ ২০২৩ সালটা বলিউড বাদশা শাহরুখ খানের!