সিনেমায় নায়ক এবং খলনায়কের সংঘাত চিরাচরিত একটি ধারা। একসময় নায়ক বনাম খলনায়ক একজন অভিনেতার পরিচয় ছিলো। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই নায়ক-খলনায়কের ব্যবধান অনেকটাই অদৃশ্য। সব অভিনেতাকেই দেখা যায় দুই রুপেই পর্দা হাজির হচ্ছেন অভিনেতারা। তবে একসময় নায়করা সিক্ত হতেন দর্শকদের ভালোবাসায় আর খনায়কদের ভাগ্যে জুটতো গালি। অন্যান্য দেশের মত ঢাকাই সিনেমায় নায়ক এবং খলনায়কের সংস্কৃতি অনেক পুরনো। ঢালিউডে এমন কিছু অভিনেতা রয়েছেন যারা দীর্ঘ সময় খলনায়ক হিসেবে পর্দা কাঁপালেও সিনেমায় তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিলো নায়ক হিসেবে। ঢাকাই সিনেমায় নায়ক থেকে খলনায়ক হয়ে দর্শক মাতানো সেইসব অভিনেতাদের নিয়ে আলোচনা থাকছে আজকের এই লিখায়।
১। রাজীব
ঢাকাই সিনেমার অন্যতম শক্তিশালী অভিনেতা ওয়াসিমুল বারী রাজীব। খলনায়ক চরিত্রে অভিনেতা হিসেবে রাজীব ছিলেন অনন্য। ভরাট কণ্ঠ, দৈহিক গঠন এবং ভযংকর সব অঙ্গভঙ্গির কারনে যেকোন নির্মাতার কাছে তিনি ছিলেন প্রথম পছন্দ। খলনায়ক হিসেবে পরিচিত এবং জনপ্রিয় হলেও সিনেমায় রাজীবের পথচলা নায়ক হিসেবে। ১৯৮১ সালে ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’ সিনেমায় প্রথম তিনি নায়ক হয়ে অভিনয় করলেও তারকাখ্যাতি পান কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘খোকনসোনা’ সিনেমার মাধ্যমে। অভিনয়ের জন্য মোট চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন এই অভিনেতা। ১৯৮৮ সালে ‘হীরামতি’ সিনেমার জন্য প্রথমবারের মত পুরস্কার জিতেন তিনি। এরপর ক্রমান্বয়ে ১৯৯১ সালে ‘দাঙ্গা’, ২০০০ সালে ‘বিদ্রোহ চারিদিকে’ এবং ২০০৩ সালে ‘সাহসী মানুষ চাই’ সিনেমার জন্য পুরস্কার পেয়েছিলেন প্রয়াত এই অভিনেতা।
২। খলিল
ঢালিউডের শক্তিমান অভিনেতা খলিল তার জীবদ্দশায় প্রায় ৮০০ সিনেমায় অভিনয় করেছেন। এরমধ্যে বেশীরভাগ সিনেমায় খলনায়ক চরিত্রেই দেখা গেছে তাকে। তবে সিনেমায় খলিলের যাত্রা শুরু হয়েছিলো নায়ক হিসেবে। ‘সোনার কাজল’ সিনেমায় খলিলকে প্রথমবারের মত নায়ক হিসেবে অভিনয় করেন। সিনেমাটি যৌথভাবে পরিচালনা করেছেন জহির রায়হান ও কলিম শরাফী। আর এই সিনেমায় খলিলের নায়িকা ছিলেন সুমিতা দেবী ও সুলতানা জামান। এরপর ‘প্রীত না জানে রীত’, ‘সঙ্গম’, ‘জংলি ফুল’ সহ আরও কয়েকটি সিনেমায় নায়ক হিসেবে দেখা গেছে তাকে। পরবর্তিতে এসএম পারভেজ পরিচালিত ‘বেগানা’ সিনেমার মাধ্যমে খলনায়ক হিসেবে প্রথম অভিনয় করেন খলিল। ২০১২ সালে এই গুণী শিল্পী জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-এ আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন। এছাড়া, ‘গুণ্ডা’ সিনেমায় অভিনয় করার জন্য প্রথমবার পেয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। কোন বিরতি ছাড়াই বিভিন্ন মাধ্যমে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অভিনয় করে গেছেন এই অভিনেতা।
৩। সাদেক বাচ্চু
১৯৮৫ সালে ‘রামের সুমতি’ সিনেমার মাধ্যমে ঢাকাই সিনেমায় নায়ক হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছিলেন সাদেক বাচ্চু। সিনেমাটিতে তিনি সুনেত্রার বিপরীতে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কিন্তু সিনেমাটি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। এরপর কিংবদন্তি নির্মাতা এহতেশাম পরিচালিত ‘চাঁদনী’ সিনেমায় নাম পরিবর্তন করে মাহবুব আহমেদ সাদেক থেকে হয়ে যান সাদেক বাচ্চু। আর খলনায়ক হিসেবে প্রথম অভিনয় করেন ‘সুখের সন্ধানে’ সিনেমায়। এরপর দীর্ঘ ক্যারিয়ারে রাজীব, হুমায়ূন ফরিদী এবং মিজু আহমেদের পাশাপাশি সমানতালে অভিনয় করেছেন খল চরিত্রে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০০ সিনেমায় অভিনয় করেছেন এই অভিনেতা। অভিনয় জীবনের সর্বোচ্চ অর্জন হিসেবে ২০১৮ সালে ‘একটি সিনেমার গল্প’ চলচ্চিত্রে খলচরিত্রে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন সাদেক বাচ্চু।
৪। বাবর
নতুন প্রজন্মের দর্শকদের কাছে খলনায়ক বাবর অনেকটাই অজানা। তবে ঢাকাই সিনেমার সোনালী সময়ের দর্শকদের কাছে খুবই পরিচিত নাম বাবর। তবে ঢাকাই সিনেমায় নায়ক হিসেবেই আবির্ভুত হয়েছিলেন এই অভিনেতা। আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘বাংলার মুখ’ সিনেমায় তিনি প্রথম নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন। পরবর্তিতে নায়ক রাজ রাজ্জাক প্রযোজিত এবং জহিরুল হক পরিচালিত ‘রংবাজ’ সিনেমার মাধ্যমে খলনায়ক হিসেবে নিজেকে দর্শকদের সামনে উপস্থিত হন বাবর। ‘রংবাজ’ সিনেমার বিশাল সাফল্যের পর খলনায়ক হসেবেই প্রতিষ্ঠিত হন এই অভিনেতা। নিজের ক্যারিয়ারে বাবর প্রায় তিনশ’ ছবিতে অভিনয় করেছেন।
৫। মিশা সওদাগর
এফডিসির ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ঢাকাই সিনেমায় নাম লিখিয়েছিলেন মিশা সওদাগর। তবে চিরচেনা খলনায়ক রূপে নয়, নায়ক হিসেবে। ১৯৮৯ সালে ছটকু আহমেদ পরিচালিত ‘চেতনা’ সিনেমায় নায়ক হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছিলেন তিনি। এছাড়া ‘অমরসঙ্গী’ সিনেমায়ও নায়ক হিসেবে দেখা গেছে মিশাকে। পরবর্তিতে ‘আশা ভালোবাসা’ সিনেমায় খলনায়ক হিসেবে প্রথম অভিনয় করেন মিশা সওদাগর। রাজীব এবং হুমায়ূন ফরিদীর পর খলনায়ক হিসেবে নির্মাতাদের প্রথম পছন্দ হয়ে উঠেন মিশা সওদাগর। নিজের ৩০ বছরের ক্যারিয়ারে মিশা সওদাগর প্রায় ৯০০ টির বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। বর্তমানে অভিনয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এই অভিনেতা।
৬। ওমর সানী
নব্বই দশকের অন্যতম জনপ্রিয় তারকদের একজন ওমর সানী। ১৯৯২ সালে নুর হোসেন বলাই পরিচালিত ‘এই নিয়ে সংসার’ সিনেমার মাধ্যমে ঢালিউডে নাম লিখান এই অভিনেতা। কিন্তু তার মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম সিনেমা ‘চাঁদের আলো’, যা মুক্তি পায় ১৯৯৩ সালে। এরপর ১৯৯৪ সালে দিলীপ বিশ্বাসের সুপারহিট ‘দোলা’ সিনেমায় প্রথমবারের মতো মৌসুমীর বিপরীতে অভিনয় করেন ওমর সানী। সালমান শাহ’র সমসাময়িক সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় নায়ক ওমর সানী মৌসুমীর সাথে জুটি করে উপহার দিয়েছেন অনেকগুলো ব্যবসা সফল সিনেমা। রোম্যান্টিক নায়ক হিসেবে আবির্ভুত হলেও অ্যাকশন সিনেমায়ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ২০০৫ সালে শাকিব খান অভিনীত ‘ওরা দালাল’ সিনেমায় প্রথমবারের মতো খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এরপর বেশ কয়েকটি সিনেমায় খলনায়ক হিসেবে পর্দায় দেখা গেছে ওমর সানীকে।
প্রিয় পাঠক, উপরে উল্লেখিত অভিনেতাদের মধ্যে খলনায়ক হিসেবে কে আপনার কাছে বেশী জনপ্রিয় তা জানিয়ে দিন আমাদের মন্তব্যে। এছাড়া আপনার জানা মতে এই তালিকার বাইরে আর কোন অভিনেতা নায়ক থেকে খলনায়ক হিসেবে পর্দায় হাজির হয়েছেন তাও জানিয়ে দিতে পারেন আমাদের।
আরো পড়ুনঃ
ঢালিউডের জুটি: ঢাকাই সিনেমার আলোচিত যত নায়ক-ভিলেন জুটি
ঢালিউডের গৌরবময় অতীত: আমাদের সোনালি সময়ের সেইসব খলনায়কেরা