প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম সিনেমা চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘ওরা ১১ জন’। সিনেমাটি নির্মানের সময়ের বিভিন্ন প্রতিকূলতার গল্প জানা গেছে নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলামের জীবনী থেকে। আর এইসব প্রতিকূলতাকে পিছিনে ফেলে সিনেমাটিকে বাস্তবের রুপ দিতে যিনি বটবৃক্ষের মত দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি সিনেমাটির প্রযোজক সম্মুখ সমরের মুক্তিযোদ্ধা মাসুদ পারভেজ। বাবার পেনশনের টাকা দিয়ে শুরু করেছিলেন সিনেমার অর্থায়ন তারপর একটু একটু করে প্রদর্শকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে নিশ্চিত করেন বাংলা সিনেমার নতুন এক ইতিহাসের। প্রযোজক হিসেবে সিনেমার সাথে যার সখ্যতার শুরু, সেই প্রযোজক মাসুদ পারভেজই একসময় পর্দা কাঁপিয়েছেন ড্যাশিং হিরো সোহেল রানা নামে। একাধারে প্রযোজক, পরিচালক এবং অভিনেতা – সব ক্ষেত্রে সমানভাবে সফলতার উদাহরণ বাংলাদেশের সিনেমায় মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানা ছাড়া আর দ্বিতীয়টি নেই।
প্রযোজক মাসুদ পারভেজ থেকে নায়ক সোহেল রানা হয়ে উঠার পিছিনের গল্পটাও সেই প্রযোজনা থেকেই। ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমার সাফল্যে এবং প্রশংসায় উৎসাহিত হয়েই তিনি নির্মাণ করতে উদ্যত হন কাজী আনোয়ার হোসেনের বিখ্যাত কাল্পনিক চরিত্র মাসুদ রানা সিরিজের ‘বিস্মরণ’ গল্প অবলম্বনে ‘মাসুদ রানা’ সিনেমা। কিন্তু নায়ক সংকটে পড়ে সুমিতা দেবী আর আহমেদ জামান চৌধুরীর পরামর্শে নিজেই নায়ক হিসেবে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন মাসুদ পারভেজ। সিনেমাটির নায়ক হিসেবে ‘সোহেল রানা’ নাম নিয়ে যাত্রা শুরু করেন এই অভিনেতা পাশাপাশি একই সিনেমার মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে আবির্ভুত হন তিনি। ‘মাসুদ রানা’ সিনেমাটি বাংলা চলচিত্রের জন্য মাইলফলক হয়েই থাকবে কারন – এই সিনেমায় আমরা পেলাম পরিচালক মাসুদ পারভেজ এবং ড্যাশিং হিরো সোহেল রানাকে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সিনেমার প্রযোজক মাসুদ পারভেজ হয়ে গেলেন নায়ক সোহেল রানা।
বাংলা সিনেমায় অ্যাকশনের প্রচলন এবং প্রতিষ্ঠায় যেকজন মানুষের অবদান অনস্বীকার্য তার মধ্যে অন্যতম সোহেল রানা। প্রযোজক-পরিচালক হিসেবে যেমন অ্যাকশন নির্ভর সিনেমা তৈরী করছেন তেমনি নায়ক হিসেবে সিনেমায় মর্ডান অ্যাকশনের যাত্রা তার হাত ধরেই শুরু। সত্তরের দশকের মাঝ থেকে আশির দশক পর্যন্ত তিনি সুপারস্টার ইমেজে ঢাকাই ছবিতে অভিনয় করেছেন সোহেল রানা। নিজ পরিচালনায় সেই ‘মাসুদ রানা’, ‘এপার ওপার’, ‘গুনাহগার’, ‘জীবন নৌকা’, ‘নাগপূর্ণিমা’, ‘হাইজ্যাক’, ‘শরীফ বদমাশ’, ‘ঘেরাও’, ‘রিটার্ন টিকেট’, ‘ভালোবাসার মূল্য কত’, দেওয়ান নজরুল পরিচালিত ‘দোস্ত দুশমন’, কামাল আহমেদ পরিচালিত ‘লালু ভুলু’, দিলীপ বিশ্বাসের ‘অজান্তে’, মুহাম্মদ হান্নানের ‘সাহসী মানুষ চাই’সহ অসংখ্য সিনেমায় দর্শকপ্রিয়তার পাশাপাশি অর্জন করেছেন একাধিক পুরষ্কার। নিজের ক্যারিয়ারে আড়াই শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন এই অ্যাকশন এম্পায়ার হিরো নায়ক সোহেল রানা।
অ্যাকশন নির্ভর সিনেমায় বেশী দেখা গেলেও তার অভিনীত সিনেমায় বৈচিত্র ছিল। একধরনের সিনেমায় অভিনয়ের পরিবর্তে তিনি তার অভিনয়ের বৈচিত্র দেখিয়েছেন অনেক সিনেমায়। রোমান্টিক, অ্যাকশন, সামাজিক – সব ধরনের ছবিতেই সোহেল রানা ছিলেন সফল। তার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে পরিচালক খসরু নোমান নির্মাণ করেন ‘সোহেল রানা’ সিনেমাটি। বাংলাদেশে কোনো সিনেমার নায়কের নামে প্রথম বাণিজ্যিক সিনেমা ছিল এটি। বৈচিত্রের কথা বললে বলা যায় ‘মাসুদ রানা’, ‘জীবন নৌকা’, ‘আলী আসমা’, ‘এপার ওপার’, ‘নাগপূর্ণিমা’, ‘যাদুনগর’ সহ আরো অনেক সিনেমার নাম। এরমধ্যে ‘মাসুদ রানা’ সিনেমাটি গোয়েন্দাকাহিনী ভিত্তিক সাহিত্যনির্ভর সিনেমা। স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য কলহ নিয়ে নির্মিত দেশের অন্যতম একটি ক্ল্যাসিক ‘জীবন নৌকা’ সোহেল রানার অন্যতম সেরা অভিনয়ের সিনেমা হিসেবে থাকবে। একদম প্রেমের গল্পের সিনেমা ‘এপার ওপার’ যেমন আছে তেমনি আছে লোককাহিনী ভিত্তিক সিনেমা ‘আলী আসমা’, ‘নাগপূর্ণিমা’ এবং ‘যাদুনগর’।
অভিনেতার পাশাপাশি একজন প্রযোজক এবং পরিচালক হিসেবেও মাসুদ রানা ছিলেন অনন্য। বাংলা সিনেমায় মার্শাল আর্ট ভিত্তিক সিনেমার যাত্রা শুরুর পিছনে মাসুদ পারভেজ নামটি স্বর্নাক্ষরে লিখা থাকবে। কখনও প্রযোজক কখনও পরিচালক হিসেবে তার মাধ্যমেই মার্শাল আর্ট সিনেমাগুলো পেয়েছে পূর্নতা। আশির দশকের শুরুতে ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলমকে সঙ্গে নিয়ে তিনি নির্মাণ করেন ‘শরীফ বদমাশ’ সিএনমাটি। এরপর ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলমের মার্শাল আর্টভিত্তিক ‘মার্শাল হিরো’ সিনেমায় অভিনয় করেন সোহেল রানা। অন্যদিকে তার প্রযোজিত সিনেমা ‘লড়াকু’ দেশের মার্শাল আর্টভিত্তিক প্রথম পূর্ণাঙ্গ ও সফলতম ছবি। এই সিনেমার মাধ্যমেই ঢালিউডে রচিত হয়েছিল অন্য আরেকটি অধ্যায়ের – মার্শাল আর্ট সিনেমায় রুবেল নামের সেই মহাকাব্যের শুরুটা এই সিনেমা দিয়েই। এছাড়া আছে চীনের উপকথা অবলম্বনে নির্মিত মার্শাল আর্ট কেন্দ্রিক সিনেমা ‘বজ্রমুষ্টি’। পরিচালক মাসুদ পারভেজের মাধ্যমে ‘শত্রু সাবধান’ সিনেমায় দেশীয় দর্শকরা প্রথম দেখল ড্রাঙ্কেন কুংফু, ‘বাঘের থাবা’ সিনেমায় দর্শকরা প্রথম দেখলেন উইপিং কুংফু আর ‘অন্ধকার চারদিকে’ সিনেমায় দেখা গেছে ব্লাইন্ড কুংফু। ‘রিটার্ন টিকেট’ কিংবা অশ্লীলতার বিরুদ্ধে একটি এক্সপেরিমেন্টহিসেবে ‘ভালোবাসার মূল্য কত’ সিনেমাগুলো পরিচালক মাসুদ পারভেজের কাজ হিসেবে আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে।
অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে দুইবার সহ তিনি জাতীয় পুরষ্কার জিতেছেন মোট তিনবার। সম্প্রতি পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা পুরষ্কার। সোহেল রানার ছেলে মাশরুর পারভেজও চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত। ২০১৩ সালে সোহেল রানা তার একমাত্র পুত্র মাশরুর পারভেজ জিবরানকে নিয়ে নির্মাণ করেন ‘অদৃশ্য শত্রু’ ছবিটি। এছাড়া ‘রাইয়ান’ নামে আরো একটি সিনেমায় দেখা গেছে মাশরুর পারভেজ জিবরানকে। দুটি সিনেমায়ই অভিনয় করেছেন সোহেল রানা। সোহেল রানার ক্যারিয়ারে একটি সিনেমা নিয়ে বেশ সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে। তার নিজের পরিচালনায় ‘খাইছি তোরে’ সিনেমাটি নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল সে সময়ে। সিনেমার নাম এবং সিনেমায় ডিপজলের কিছু সংলাপ এবং প্রদর্শিত নৃশংশতার কারনে সমালোচনা হয়েছিল সিনেমাটি নিয়ে।
‘মাসুদ রানা’ দিয়ে যাত্রা শুরু করা এই ড্যাশিং হিরোর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে ‘এপার ওপার’, ‘জিন্জির’, ‘জীবন নৌকা’, ‘ঘরের শত্রু’, ‘লালুভুলু’, ‘দোস্ত দুশমন’, ‘দাতা হাতেম তাই’, ‘রাজা জনি’, ‘অত্যাচার’, ‘চোখের পানি’, ‘দুঃসাহস’, ‘অপহরণ’, ‘গাদ্দার’, ‘প্রতিহিংসা’, ‘রক্তের বন্দি’, ‘বারুদ’, ‘চোর’, ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘পরাধীন’, ‘জারকা’, ‘আসামী হাজির’, ‘মিন্টু আমার নাম’, ‘শরীফ বদমাশ’, ‘নাগ পূর্ণিমা’, ‘কমান্ডার’, ‘দুই প্রেমিক’, ‘অভিযোগ’, ‘শাহী খানদানি’, ‘মারকশা’, ‘লড়াকু’, ‘টপ রংবাজ’, ‘ঘর আমার ঘর’, ‘স্ত্রী’, ‘হুমকি’, ‘বদলা’, ‘বড়মা’, ‘জনি’, ‘বজ্রমুষ্টি’, ‘মার্শাল হিরো’, ‘প্রতিহিংসা’, ‘তিনকন্যা’, ‘অজান্তে’, ‘কলমিলতা’, ‘গৃহযুদ্ধ’, ‘মৃত্যুর সাথে পাণ্জা’, ‘মায়ের মর্যাদা’, ‘জজ ব্যারিস্টার পুলিশ কমিশনার’, ‘প্রবেশ নিষেধ’, ‘সাহসী মানুষ চাই’, ‘ভয়ঙ্কর বিষু’, ‘খাইছি তোরে’, ‘অদৃশ্য শত্রু’, ‘টাকা’, ‘মোস্ট ওয়েলকাম’, ‘স্বামীর সংসার’, ‘রিটার্ন টিকেট’, ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী’।
সমসাময়িক অন্য তারকাদের মত জুটি নির্ভর ছিলেন না সোহেল রানা। তবে একাধিক নায়িকার সাথে তাকে বেশ কয়েকটি সিনেমায় দেখা গেছে। এরমধ্যে ববিতা, শাবানা এবং সুচরিতা উল্লেখযোগ্য। নায়ক হিসেবে প্রথম সিনেমায় কবরীর বিপরীতে অভিনয় করলেও কবরীর সাথে জুটি সেভাবে গড়ে উঠেনি শেষ পর্যন্ত। পরবর্তীতে সুবর্ণা মুস্তাফার সাথে বেশ কয়েকটি সিনেমায় দেখা গেছে সোহেল রানাকে এবং সেগুলো জনপ্রিয়তা অর্জনেও সক্ষম হয়।
মাসুদ পারভেজ বলেন আর সোহেল রানা বলেন – বাংলা সিনেমায় তার অবদান বহুমুখী। একাধারে একজন প্রযোজক, পরিচালক এবং অভিনেতা হিসেবে তার অবদান ঢালিউডে তাকে অনন্য এক অবস্থানে নিয়ে গেছে। বর্তমান সময়ে ঢালিউডের অবস্থার উত্তরণে এরকম মানুষের প্রয়োজন আমরা অনুভব করছি প্রতিটি পদক্ষেপে। সোহেল রানার মত তারকারা বেঁচে থাকেন তাদের কাজের মধ্যে দিয়ে – অনন্ত কাল!
আরো পড়ুনঃ
মেগা ষ্টার উজ্জ্বলঃ সাদাকালো সিনেমার যুগ থেকে রঙ্গিন চলচ্চিত্রের নায়ক
অ্যাকশন কিং জসিমঃ অসম্ভবকে সম্ভব করা সত্যিকারের এক নায়ক
লড়াকু নায়ক রুবেল: বাংলা চলচ্চিত্রের অনন্য এক অ্যাকশন হিরো’র গল্প
মহানায়ক মান্না: নব্বই দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের এক ‘তেজি পুরুষ’