২০২২ সালটি সিনেমায় কিংবদন্তী পরিচালক প্রিয়দর্শনের ৪৩তম বছর হতে যাচ্ছে। ‘থিরনোট্টম’ (মোহনলালের অভিষিক্ত সিনেমা) নামে অপ্রকাশিত একটি সিনেমা দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন প্রিয়দর্শন। এরপর সিনেমায় বেশ কয়েকটি বিপ্লবের সাক্ষী হয়ে আসছেন এই কিংবদন্তী নির্মাতা। যার মধ্যে রয়েছে কালো-সাদা থেকে রঙ্গিন, ফিল্ম থেকে ডিজিটাল, একক স্ক্রীন থেকে ওটিটি (তার হাঙ্গামা ২ সিনেমাটি সরাসরি ওটিটিতে মুক্তি পেয়েছিলো) – সব বিপ্লবের এক রাজসাক্ষী হয়ে আছেন তিনি। এছাড়া তার সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘মারক্কারঃ দ্যা লায়ন অব এরাবিয়ান সি’ মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় বাজেট এবং সাম্প্রতিক সময়ের সর্বাধিক আলোচিত সিনেমা ছিলো।
এই পরিসংখ্যানগুলিকেলোর প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় কিছু কিংবদন্তী পরিচালক প্রিয়দর্শনের মতো প্রশংসিত হয়েছেন। মালায়ালাম নির্মাতাদের মধ্যে তার চেয়ে কিছুটা এগিয়ে আছেন জে. শশিকুমার (১৪০টির বেশী সিনেমা) এবং এম. কৃষ্ণান নায়ার (৮০টির বেশী সিনেমা)। এর বাইরে দক্ষিণের এম. কৃষ্ণান নায়ার (তামিল সহ অন্যান্য ভাষায় ১৪০টির বেশী সিনেমা) এবং কে. বালাচন্দর (চিত্রনাট্যকার বা পরিচালক হিসাবে ১০০টিরও বেশি সিনেমা) নির্মান করে তার থেকে এগিয়ে আছেন। তবে এখনো সক্রিয়ভাবে কাজ করা পরিচালকদের মধ্যে, শুধুমাত্র সত্যান আঁথিকাদ, রাম গোপাল ভার্মা এবং ডেভিড ধাওয়ান প্রিয়দর্শনের কাছাকাছি আসতে সক্ষম হয়েছেন।
বর্তমানে প্রিয়দর্শনের ব্যস্ততা দেখে মনে হচ্ছে তিনি আরও অনেক বছর তার তালিকায় নতুন সিনেমা যোগ করতে থাকবেন। কিন্তু সংখ্যার এই খেলায়, পরিচালকের মনে হয় একটি ‘অন্যায়’ সুবিধা হল তার ফিল্মগ্রাফিতে প্রচুর সংখ্যক রিমেক। এখন পর্যন্ত প্রিয়দর্শনের মুক্তিপ্রাপ্ত ৭৮টি সিনেমার মধ্যে ৩০টি সিনেমা অন্য ভাষার সিনেমার পুরো বা আংশিক নকল। এছাড়া কিছু সিনেমার কিছু দৃশ্য অথবা অংশ অন্যভাষার সিনেমা থেকে ধার করা। অন্যদিকে তার নির্মিত কিছু সিনেমা আছে যা তার ওরিজিনাল মালায়ালাম সিনেমা থেকে অন্যভাষায় নির্মান করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ, অক্ষয় কুমার অভিনীত তার হিন্দি সিনেমা ‘দে দানা দান’ হলিউড কমেডি ‘স্ক্রুড’ থেকে নকল করা হয়েছিল। তবে এটি তার নিজের মালয়ালাম সিনেমা ‘ভেট্টাম’ থেকেও ধার করেছে, যেটিতে তিনি নিজেই ‘ফ্রেঞ্চ কিস’ এবং ‘হাঙ্গামা’র মতো সিনেমার দৃশ্য এবং প্লট ব্যবহার করেছিলেন। আর তার আলোচিত সিনেমা ‘হাঙ্গামা’ ছিল তার নিজের সিনেমা ‘পুচাক্কোরু মুককুঠি’র রিমেক যা ছিলো আবার তেলেগু ‘গোপালা রাও গারি আম্মায়ি’, তামিল ‘কোটিশ্বরন মাগাল’ এবং ইংরেজি নাটক ‘দ্য স্ট্রেঞ্জ জেন্টলম্যান’র সংমিশ্রণ।
নিজের সিনেমার পুননির্মান
যদিও প্রিয়দর্শন হিন্দিতে বেশ কয়েকটি সফল রিমেক করেছিলেন তার সবকটি নিজের মালায়ালাম সিনেমার রিমেক ছিলো না। বরং অন্য নির্মাতাদের রিমেকে তিনি বেশী সফল ছিলেন। তার নির্মিত হিন্দি সিনেমার মধ্যে ‘হাঙ্গামা’ তার নিজের ব্যবসা সফল কমেডি ‘পচাকুরু মোকুথাই’ সিনেমার রিমেক ছিলো। আর ‘হাঙ্গামা ২’ ছিলো ‘মিনারাম’ সিনেমার হিন্দি সংস্করণ। এছাড়া অরবিন্দ গোস্বামী অভিনীত ‘সাত রং কে স্বপ্নে’ সিনেমাটি তার মালায়ালাম সিনেমা ‘থেনমাভিন কোম্বাথু’ এবং ‘মুস্কুরাহাত’ ছিলো ‘কিলুক্কাম’ সিনেমার হিন্দি রিমেক।
একই ভাবে অক্ষয় কুমার অভিনীত ‘গরম মশলা’ সিনেমাটি তার নিজের নির্মিত আশির দশকের ‘বোয়িং বোয়িং’ এবং ‘খাট্টা মিট্টা’ তার ওরিজিনাল সিনেমা ‘ভেল্লানাকালুডু নাদু’ সিনেমা থেকে হিন্দিতে পুননির্মিত করেছিলেন। অন্যদিকে সালমান খানকে নিয়ে নির্মিত ‘কিউ কি’ সিনেমাটি তার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের ‘থালাভাত্তাম’ সিনেমার রিমেক ছিলো। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর উল্টোটাও দেখা গেছে। অন্য ভাষা থেকে হিন্দিতে রিমেকের পাশাপাশি তার নিজের নির্মিত হিন্দি সিনেমাও তিনি অন্য ভাষায় পুননির্মান করছেন। তার নির্মিত হিন্দি সিনেমা ‘মালামাল উইকলি’ সিনেমাটি তিনি মালায়ালাম ভাষায় নির্মান করেছিলেন ‘আমায়াম মুয়ালাম’ নামে।
অন্য নির্মাতার সিনেমার পুননির্মান
কিংবদন্তী পরিচালক প্রিয়দর্শনের সিনেমার বড় একটি অংশ নির্মিত হয়েছে অন্য নির্মাতার সিনেমার রিমেকের মাধ্যমে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বহুল আলোচিত ‘বুল বুলাইয়া’। সিনেমাটি নির্মাতা ফাজিল পরিচালিত ‘মানিচিত্রাথাজু’ সিনেমার হিন্দি সংস্করণ ছিলো। একইভাবে অনিল কাপুর অভিনীত ‘ভিরাসাত’ সিনেমাটি ভারাতনের তামিল সুপারহিট ‘তেভার মাগান’ সিনেমা থেকে হিন্দিতে নির্মান করেছিলেন প্রিয়দর্শন। এছাড়া প্রিয়দর্শনের ‘হেরা ফেরি’ সিনেমাটি যুগল পরিচালক সিদ্দিকী লালের ‘রামজি রাও স্পিকিং’ সিনেমার হিন্দি সংস্করণ ছিলো।
এছাড়া তার নির্মিত অন্যান্য হিন্দি সিনেমা ‘ঢোল’ (ইন হারিহার নগর), ভাগাম ভাগ (মান্নার মাথাই স্পিকিং) এবং ‘হালচাল’ (গডফাদার) সিদ্দিকী লাল নির্মিত সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত ছিলো। অন্যদিকে ‘ডোলি সাজাকে রাখনা’ ফাজিলের ‘আন্নাথুপুরাভু’, ‘চুপ চুপ কে’ রাফির ‘পাঞ্জাবী হাউজ’, ‘কামাল ধামাল মালামাল’ শাফির ‘মারিক্কুন্ধরু কুঞ্জারু’ এবং ‘গারদিশ’ মালাইলির ‘কিরেধাম’ সিনেমার উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছিলো। শুধু তাই নয় প্রিয়দর্শন পরিচালিত ‘মেরে বাপ পেহলে আপ’ মালাইলির ‘ইশথাম’ সিনেমার পুননির্মান ছিলো।
অন্যদিকে ‘ইয়ে তেরা ঘর ইয়ে মেরা ঘর’ সিনেমাটি সাথ্যান পরিচালিত ‘আন্থিখান্ডস সান্মানাসসুলাভারক্কু সামাধানান’ এবং ‘বিল্লু’ ‘কাধা পারায়ুম্বল’ সিনেমার হিন্দি সংস্করণ ছিলো। তালিকাটা এখানেই শেষ নয়। সামুথিরাকানি পরিচালিত ‘নাদোদিগাল’ সিনেমাটি প্রিয়দর্শন নির্মান করেছিলেন ‘রংগ্রেজ’ নামে। আর ‘বাম বাম বোলে’ আলোচিত ইরানি নির্মাতা মাজিদ মাজিদির ‘চিলড্রেন অফ হ্যাভেন’ সিনেমা থেকে হিন্দিতে পুননির্মান করেছিলেন প্রিয়দর্শন। হিন্দির পাশাপাশি তার তামিল এবং তেলুগু সিনেমার বেশীরভাগও ছিলো রিমেক।
আংশিক অথবা অর্ধেক পুননির্মান
কিংবদন্তী পরিচালক প্রিয়দর্শনের প্রথমদিকের বেশীরভাগ সিনেমাই ছিলো অন্য সিনেমার আংশিক অথবা অর্ধেক পুননির্মান। ইংরেজি সহ অন্যান্য ভাষার সিনেমার আংশিক অংশ নকল করে মালায়ালাম ভাষায় নির্মান করেছেন এই নির্মাতা। উদাহরণস্বরূপ, ‘কাকাকুইল’ এবং ‘চন্দ্রলেখা’ সিনেমাগুলোর প্লট তিনি যথাক্রমে ‘এ ফিশ কল্ড অয়ান্ডা’ এবং ‘হুয়াইল ইউ আর স্লিপিং’ সিনেমা থেকে নিয়েছিলেন। এছাড়া হিন্দি নির্মাতা সাই পারাঞ্জপির ‘কাঁথা’ থেকে তিনি নির্মান করেছিলেন ‘মুকুনদেত্তানে সুরিমিত্রা ভিল্লিক্কুন্নো’ সিনেমাটি।
মৌলিক সিনেমা
ভারতীয় সিনেমায় কিংবদন্তী পরিচালক প্রিয়দর্শনের অবস্থান এখনও এত সম্মানের হওয়ার একটি কারণ, বিশেষ করে মালায়লাম ভাষায়, গল্পবলার ধরনের উপর দুর্দান্ত নিয়ন্ত্রণের সাথে একজন গুরুতর বিষয়কে সিনেমায় রূপান্তরিত করার ক্ষমতা। তিনি বিরল ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে একজন, যিনি সেরা ফিচার ফিল্মের জন্য দুটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন (কাঞ্চিভারম এবং মারাক্কার)। তার কাছে মালায়ালাম ভাষায় অরিজিনালের একটি সেটও রয়েছে যেগুলি উভয়ই অত্যন্ত সফল এবং অনেক প্রিয়। চিত্রনাট্যকার টি.দামোদরন এবং শ্রীনিবাসনের সাথে এমন কিছু ড্রামা এবং ঐতিহাসিক সিনেমা তিনি উপহার দিয়েছেন যা তার নিজস্ব ধরন থেকে আলাদা ছিলো। এরমধ্যে ‘আরিয়ান’, ‘এদভাইথাম’ এবং ‘কালাপানি’ সিনেমাগুলোর ব্যবসায়িকভাবে সফল ছিলো।
হিন্দি, তামিল, তেলুগু এবং ‘মালায়ালাম’ – ভারতের সবকয়টি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে চার দশকেরও বেশী সময় ধরে দর্শকদের বিনোদন দিয়ে আসছেন প্রিয়দর্শন। তার নির্মিত সিনেমাগুলো যেমন দর্শকদের বিনোদন দেয় তেমনি তুলে ধরে চলমান বিভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষাপটকে। শুধু তাই নয়, তার সিনেমার গল্পে উঠে এসেছে এমন কিছু প্রেক্ষাপট যেটা নিয়ে সিনেমা নির্মান যেকোন নির্মাতার জন্য দুঃসাহসের বিষয়। আগামী দিনগুলোতে নিজস্ব ধারায় সিনেমা নির্মানের মাধ্যমে ভারতীয় দর্শকদের তিনি বিনোদন দিবেন আরো অনেক বছর। এমনটাই প্রত্যশা সবার।
আরো পড়ুনঃ
দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার কাছে নাস্তানাবুদ বলিউডঃ কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা
বিক্রমাদিত্য মোটওয়ানের ‘উড়ান’: যুগান্তকারী যে সিনেমার গল্প আজও প্রাসঙ্গিক
রাম গোপাল ভার্মার ‘সত্যা’: বলিউডে গ্যাংস্টার সিনেমার ধারা বদলের উপ্যাখ্যান