টেনেট রিভিউঃ মগজের খেলার একটি পরিপূর্ন উপস্থাপন

চলচ্চিত্রের নামঃ টেনেট (২০২০)
মুক্তিঃ ২৬শে আগস্ট ২০২০ ( ইউকে) এবং সেপ্টেম্বর ৩ ২০২০ (ইউএসএ)
অভিনয়েঃ জন ডেভিড ওয়াশিংটন, রবার্ট পেটিসন, এলিজাবেথ দেবিকি, ডিম্পল কাপাডিয়া, মাইকেল কেইন এবং কেনেথ ব্রাঙ্গা প্রমুখ।
পরিচালনাঃ ক্রিস্টোফার নোলান
প্রযোজনাঃ এমা টমাস এবং ক্রিস্টোফার নোলান
পরিবেশনাঃ ওয়ার্নার ব্রাদার্স পিকচার্স
কাহিনি, সংলাপ ও চিত্রনাট্যঃ ক্রিস্টোফার নোলান
সম্পাদনাঃ জেনিফার লামে
চিত্রগ্রহনঃ হয়তি ভেন হয়তোমা
সংগীতঃ লুডউইং গোড়ানসন

প্রারম্ভিক কথাঃ করোনা মহামারীর কারনে বেশিরভাগ সিনেমারই মুক্তি পিছিয়ে দেয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু ওয়ার্নার ব্রাদার্স প্রযোজিত সিনেমা ‘টেনেট’ একমাত্র সিনেমা যা বিশব্যাপী মুক্তি পেয়েছে। ইউকে এবং ইউএসএ এর পর সম্প্রতি সিনেমাটি ভারতেও মুক্তি পেয়েছে। ক্রিস্টোফার নোলানের সিনেমা মানেই মগজের খেলা! তাহলে কেমন হলো তার সর্বশেষ পরিচালনা? ক্রিস্টোফার নোলান কি তার নিজস্ব গল্প বলার ধরন দিয়ে দর্শকদের বিনোদন দিতে পেরেছেন। এই রিভিউতে সেটাই পর্যালোচনা করে দেখবো।

কাহিনী সংক্ষেপঃ টেনেট সিনেমার গল্প একজন সিক্রেট এজেন্টকে নিয়ে যে পৃথিবীকে অবিশ্বাস্য একটি ঝুঁকি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। বেনামী একজন সিআইএ এজেন্ট (জন ডেভিড ওয়াশিংটন) SWAT সদস্যের পরিচয় নিয়ে তার টিমসহ ইউক্রেনে একটি আন্ডারকোভার অপারেশনে যায়, যেখানে একটি বেনামী প্যাকেজ উদ্ধার করতে হবে। কিন্তু মিশনটি ব্যর্থ হয় এবং সেই এজেন্ট শত্রুদের হাতে ধরা পরে। সেখানে তাকে নির্মম ভাবে টর্চার করা হয় এবং তার আসল পরিচয় প্রকাশ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু সে নিজের পরিচয় প্রকাশ করার পরিবর্তে সায়ানাইড পিল খেয়ে আত্নহত্যার চেষ্টা করে। সেই ঘটনায় বেঁচে যাওয়ার পর সে জানতে পারে যে, এটা তার সততা পরীক্ষার জন্য একটা টেস্ট ছিলো।

টেস্টে সফলভাবে পাশ করার পর তাকে টেনেট নাম একটি সিক্রেট প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়া হয়। তাকে একটি গবেষনা প্রজেক্টে নেয়া হয়, যেখানে লরা (ক্লাইমেন্স পোইসি) তাকে জানিয়ে দেয় যে তারা বেশ কয়েকটি জিনিসের সন্ধান পেয়েছে যার এনট্রপি সময়ের বিপরীতে নিয়ে যেতে এবং সময়মকে পিছনে নিয়ে যেতে সক্ষম। ঘটনা ব্যাখ্যা করার জন্য লরা তাকে এমন একটি বুলেটের কথা বলে যা, টার্গেটকে আঘাত না করে বন্দুকে ফেরত চোলে আসে। লরা তাকে জানায় এই বস্তু আসলে ভবিষ্যতের কিন্তু এটা সবার বর্তমান এবং অতীতকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। এই বুলেটের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে উক্ত সিআইএ এজেন্ট মুম্বাইয়ে আসে, যেখানে সে তার লোকাল প্রতিনিধির সাহায্যে স্থানীয় অস্ত্র ব্যবসায়ী সঞ্জয় সিংয়ের ব্যাপারে জানতে পারে। নীল তাকে জানায় এই বুলেটের ব্যাপারে বিস্তারিত জানা সম্ভব নয়, তাদেরকে এই মিশন এখানে সমাপ্ত করতে হবে। কিন্তু এজেন্ট নীলের সাথে মাইল সঞ্জয়কে অপহরণ করে। পরে তারা জানতে পারে যে, সঞ্জয় আসলে শুধু একটা মহড়া মাত্র, এই বুলেটের মূল উদ্যোক্তা হচ্ছে সঞ্জয়ের স্ত্রী প্রিয়া সিং। প্রিয়া সিং এজেন্টকে জানায় যে, তার ফর্মুলা কোন এক রাশিয়ান মাফিয়া আন্দেরি সাতর কিনে নিয়েছে এবং সম্ভবত তারাই সেটাকে সময়ের বিপরীতে ব্যবহার করছে।

বুলেটের সম্পূর্ণ তথ্য উদ্ধারের জন্য এজেন্ট পরে স্যার মাইকেল ক্রসবির সাথে দেখা করতে লন্ডন যায়। সেখানে ক্রসবি তাকে আন্দেরির স্ত্রী ক্যাটের সাথে যোগাযোগ করতে বলে যার মাধ্যমে সে সেই মাফিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে। ক্যাট একটি শিল্প মূল্যায়নকারী যিনি সম্প্রতি তার স্বামীর কাছে একটি নকল গোয়া চিত্র বিক্রি করেছিলেন। এজেন্ট সেইমতোই ক্যাটের কাছে আরো একটি একটি নকল গোয়া চিত্রকর্মের প্রস্তাব দেয় এই আশায় যে, ক্যাট তাকে আন্দেরির সাথে দেখা করবে। কিন্তু ক্যাট এজেন্টকে জানায় যে, এই নকল চিত্রকর্ম বিক্রির পর আন্দেরি ইটা বুঝতে পেরেছে এবং তাকে ব্লেকমেইল করছে। তারই প্রেক্ষিতে এজেন্ট উক্ত চিত্রকর্মটি নরওয়ের ওসলো বিমানবন্দর থেকে চুরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরজন্য এজেন্ট এবং নীল পরিকল্পনামত ওসলো বিমানবন্দরের ফ্রিপোর্ট থেকে পাইলট মাহিরের সহায়তায় গোল্ড চুরির একটি ঘটনা সাজায়। এই গ্লোল্ড চুরির সাজানো ঘটনার সুযুগে তারা সেই গোয়া চিত্রকর্মটি চুরি করার পরিকল্পনা করে। তারা যখন চিত্রকর্মটি চুরির জন্য ফ্রীপোর্টে প্রবেশ করে এবং তাদের কাজের সাথে ব্যস্ত হয়ে উঠছে, তখন হঠাৎ করে তারা দু’জন রহস্যময় SWAT সদস্যের আক্রমণের শিকার হয় যারা একটি অদ্ভুত ঘূর্ণায়মান দরজা থেকে বেরিয়ে আসে যাদের মধ্যে একজন সময়ের সাথে পিছনে চলতে থাকে! এরপরে যা ঘটে তা ফিল্মের বাকী অংশকে রূপ দেয়।

সংলাপ ও চিত্রনাট্যঃ ক্রিস্টোফার নোলানের গল্পটি চমকপ্রদ, সহজ ভাষায় বলা যায়! তিনি এমন একটি ধারণা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করেছেন যা সত্যই এই পৃথিবীর বাইরে এবং এমন কিছু যা শ্রোতাদের তাদের মস্তিষ্কের চিন্তার গতিতে রাখতে বাধ্য করে। ক্রিস্টোফার নোলানের চিত্রনাট্য মনোমুগ্ধকর এবং ১৫০ মিনিটের রান-টাইম সত্ত্বেও দর্শদের সিনেমার সাথে আঁকড়ে ধরে রাখতে সক্ষম। তবে কয়েকটি দৃশ্য দর্শকদের বোঝা কষ্টকর হতে পারে এবং থিয়েটার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে তাদের উইকিপিডিয়ায় বা গুগলে ‘টেনেট ব্যাখ্যা’ পর্যালোচনা করতে বাধ্য করবে। ক্রিস্টোফার নোলানের সংলাপগুলি তাত্পর্যপূর্ণ এবং ফিল্মে খুব প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করে।

পরিচালনাঃ সিনেমাটির পরিচালনার ক্ষেত্রে ক্রিস্টোফার নোলান তার মেধার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করেছেন। এই ধরণের একটি বিষয়কে সিনেমাটিকভাবে আবেদনময় এবং বিনোদনমূলক করার জন্য সাহস এবং দূরদর্শিতা প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে, ক্রিস্টোফার নোলান সবসমযযার মত এবারও সফল। ফিল্মটি বেশ কিছু রোমাঞ্চকর এবং নাটকীয় মুহুর্তের সাথে পূর্ণ হয়, যা সেলুলয়েডে আগে কখনও দেখা যায়নি। দ্বিতীয়ার্ধে কিছু মোচড় ও মোড় রয়েছে যা দর্শকদের চমকে দেওয়ার এবং তাদের অর্থের মূল্য দেওয়ার বিষয়েকে নিশ্চিত করবে। এমন অনেক সময় আসে যখন দেখে মনে হয় কয়েকটি দৃশ্য বা চলমান বিষয়গুলি উদ্দেশ্যমূলকভাবে জটিল করা হয়েছে। তবে এই দৃশ্যটি কয়েক দৃশ্যে ব্যাকফায়ার করে, প্রথমার্ধেও তাই হয়। সময়ের পিছনে চলার বিষয়টি অ্যাভেঞ্জারস: এন্ড গেম [২০১৯] সিনেমায় যেভাবে সহজভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছিলো টেনেটও যদি সেই কাজটি করত তবে দর্শকদের উপর এর প্রভাব আরো বেশী মাত্রায় থাকত।

অভিনয়ঃ সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে জন ডেভিড ওয়াশিংটন আরো একবার নিজের অসাধারণ অভিনয় দক্ষতার সাক্ষর দিলেন। পুরো সিনেমাতে তার সময়পোযোগী ভাবের প্রকাশ এবং বডি ল্যাংগুয়েজ প্রতিটি দৃশ্যকে করেছে শক্তিশালী। রবার্ট পেটিসন বরাবরের মতোই তার চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন দক্ষতার সাথে। এলিজাবেত দেবিকির অংশ সিনেমার অন্যতম কঠিনতম পার্ট এবং এখানেও সে সফল। সিনেমাজুড়েই ছিলো তার অসাধারণ উপস্থিতি, বিশেষ করে শেষ দৃশ্যে তার অভিনয় তাকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়।

প্রধান খলচরিত্রে কেনেথ ব্রাঙ্গার অভিনয় আলাদাভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। সিনেমাতে তার উপস্থিতি এবং অভিনয় অন্যরকম একটা শক্তি সঞ্চয় করে সিনেমাটিতে। এছাড়া ডিম্পল কাপাডিয়া ও হিমেশ প্যাটেলসহ অন্যান্য অভিনেতারা নিজেদের চরিত্রের প্রতি ন্যায়বিচার করতে পেরেছেন।

উপসংহারঃ সামগ্রিকভাবে, টেনেট দর্শকদের বিভ্রান্ত করে এবং একটি গোলক ধাঁধা মধ্যে নুতুনত্বের আনন্দ দেয়। পাশাপাশি এর সংগীত, ভিএফএক্স এবং অ্যাকশনের জন্য এটি একটি উজ্জ্বল সিনেমাটিক অভিজ্ঞতাও সরবরাহ করে। নোলানের নিজস্ব এবং ভিন্ন ধারার গল্প বলার ধরনের কারণে একটি বিরল, উত্তেজনাপূর্ণ চলচ্চিত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।

By হোসেন মৌলুদ তেজো

এ সম্পর্কিত

%d